• উত্তরের টিকিট পাননি বেচারা রোনাল্ডো!
    এই সময় | ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • এক ফুরফুরে সকালে আমাদের পাড়ার সোমেনদাকে এলাকার নামকরা স্পোর্টস অ্যাকাডেমির চত্বরে দেখা গেল। চোখ কচলে দেখলাম, সোমেনদার হাতে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার ফর্ম। এই বুড়ো বয়সে সোমেনদা অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হবে নাকি? নাহ্, পরে জানা গেল, ফর্মটা সোমেনদার ভাইপোর নামে। কিন্তু ইন্টারেস্টটা সোমেনদার। কারণ, দার্জিলিং মেলের জাঁদরেল এক টিটিই এই অ্যাকাডেমির লাইফ মেম্বার। সপ্তাহে দু’-তিন দিন তিনি হাফপ্যান্ট পরে এখানে জগিং করতে আসেন। তাঁকে ধরে যদি উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটা টিকিট...

    সে বার সোমেনদা টিটিই-র দেখা পেয়েছিল কি না সেটা ‘হাইলি সাসপিশাস’। কিন্তু চারদিকে উত্তরের ট্রেনের টিকিটের যা হাহাকার তাতে এই ঘটনা নেহাত মামুলি। মন খুলে বেড়ানোর প্ল্যান করে শুধু কয়েকটা টিকিটের জন্য যদি এত ভোগান্তি সইতে হয়, তখন মনে হয় দক্ষিণবঙ্গে জন্মে যেন বড্ড অপরাধ করে ফেলেছি! উত্তরের ট্রেনের টিকিট মানে লটারি পাওয়া। একবার কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখদর্শন করতে যাওয়ার জন্য দক্ষিণকে যা পে করতে হয় তা উত্তর ভাবতেও পারবে না।

    সে বার ঠিক করলাম, পুজোয় বাবা-মাকে ‘বন্দে ভারত’ চাপিয়ে ডুয়ার্সটা একটু রাউন্ড দিয়ে আসব। সেই মতো চার মাস আগে কোমর বেঁধে রেডি। সকাল সাড়ে ৮টায় কাউন্টার খোলে। আগের দিন রাত দেড়টার সময়ে স্টেশনে গিয়ে দেখি, অন্তত ছ’জন অন্ধকারে বসে মশার কামড় খাচ্ছে। সবার নাম লেখা একটা ছোট্ট লিস্ট। সেটা কাউন্টারের জানলায় একটা দেড় ইঞ্চি বাই আড়াই ইঞ্চি পাথর দিয়ে চাপা দেওয়া। আমি তো হতবাক! এই রাতেই ছ'জনের লাইন?

    ফিরে আসছিলাম। একজন বললেন, ‘চলে আসুন। ছ’জন থাকবে না। এক-দু'নম্বরেই হয়ে যাবে।’ নাম লিখে শুরু হলো অপেক্ষা। তারপরে রাত ৩টে থেকে এ গলি, সে গলি থেকে পিলপিল করে লোক বেরোতে শুরু করল। লাইনটা বড় হতে হতে শেষে এমন হলো যে, ভোরের আলো যখন ফুটল তখন লাইনটা আর দেখা যাচ্ছে না। মানে, সেটা কাউন্টার থেকে বেরিয়ে মহাময়ী ভাণ্ডারের কাছে কান্নিক মেরে বাঁ দিকে ঘুরে কতটা চলে গিয়েছে তার ঠিক নেই। মহাময়ী পর্যন্ত অন্তত জনা তিরিশেক। আমি তখন পাঁচে।

    কাউন্টার খোলার সাত-আট মিনিটের মধ্যে যখন ফর্ম জমা দিলাম ততক্ষণে ‘বন্দে ভারতের' টিকিট জাস্ট উড়ে গিয়েছে। প্রায় কোনও ট্রেনেই আর টিকিট বাকি নেই। ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এসে সেই পুজোটা বাবা-মাকে নিয়ে বাঁকুড়ার জঙ্গলেই কাটিয়ে দিলাম।

    কিন্তু খবর পাওয়া গেল যে, কোনও এক জটিল এবং রহস্যময় ‘অ্যাপ’-এর পরম আশীর্বাদে পাড়ার কাতুদা এবং তার দাদার ফ্যমিলি মিলিয়ে আটটা কাঞ্চনকন্যার টিকিট কেটে উঠতে পেরেছে। এ তো আমাদের যৌথ সেলিব্রেশন। চায়ের ঠেকে আমরা কাতুদাকে চা আর লেড়ো বিস্কুট সহযোগে এক্কেবারে গণ-সংবর্ধনা দিলাম। বেশ কিছুদিন পরে কাতুদা যখন সপরিবার উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরল, শুনলাম আটটা টিকিট নানা কামরায় ডিস্ট্রিবিউটেড হয়ে যাওয়ার কারণে সারারাত পুরো ফ্যামিলির মধ্যে কো-অর্ডিনেশন রাখতে রাখতেই কাতুদার প্রাণ প্রায় বেরিয়ে যাওয়ার দশা হয়েছিল।

    একবার যখন গরমের ছুটিতে কিছুতেই এনজেপির টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না তখন ছোটবৌদি বলেছিল, ‘হ্যাঁ গো, এই যে অঞ্জন দত্ত লোকটা বছরে এতবার দার্জিলিং গিয়ে বসে থাকে, এত টিকিট পায় কী করে বলো তো?’ সেটা শুনে আমাদের আট বছরের তাতান বলে উঠেছিল, ‘ও মা, এটাও জানো না? ওরা তো বিরাট বড়োলোক। ওরা প্লেনে যায়।’ এই কথা শুনে বৌদি ছোড়দার দিকে এমন নিচু নজরে তাকিয়েছিল যে, তখনই নাকি ছোড়দার মাথায় খুন চেপে যায় এবং ছোড়দা মনস্থ করে, দরকার হলে বাড়ি বন্ধক রেখেও বৌকে নিয়ে প্লেনে দার্জিলিং যাবে। বাবা, মা-সহ ফ্যামিলির সাত জনের প্লেনের টিকিট কাটার ধনুকভাঙা পণ করেছিল ছোড়দা। অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে বার বগলদাবা করে গোপালপুর নিয়ে যাওয়া হয়।

    ‘এনজেপির টিকিট পাওয়া যাবে, তবে তার জন্য গাঁটের কড়ি খসবে।’ আমাদের বন্ধু চিকা একদিন ঠেকে চালিয়ে খেলা শুরু করল। আমরা সমস্বরে জানতে চাইলাম, 'কী ভাবে?’ স্মার্টলি উত্তর এলো, ‘এজেন্ট, বস এজেন্ট!’ এই কথাটা সেই সময়ের, যখন সবাই ভাবছে সামনের ক্রিসমাসের ছুটিতে উত্তর দিকে তাকাবে কি না। মাথা গোনা শুরু হলো এক, দুই, তিন, চার...। মোট পাঁচে দাঁড়াল তবে হরি একটু নড়বড় করছে। যাবে কি যাবে না টাইপ হয়ে আছে।

  • Link to this news (এই সময়)