এই সময়, ময়নাগুড়ি: সারিন্দার সুর বছর দুয়েক আগে পদ্ম–সম্মান এনে দিয়েছিল মঙ্গলাকান্ত রায়ের ভাঙা ঘরে। জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের ধওলাগুড়ি গ্রামের কচিকাঁচারা অবশ্য পদ্মশ্রী মঙ্গলাকান্তকে চেনে ‘মোরগদাদু’ নামে। খুদেদের আবদারে তাঁর সারিন্দায় যে উঠে আসে মোরগের ডাক। মজা পেয়ে হাত তালি দেয় বিচ্ছুদের দল। হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখগুলিতে উত্তরসূরি খোঁজেন মঙ্গলাকান্ত। কচি হাতে শুনতে চান তাঁর সুখ–দুঃখের সঙ্গী সারিন্দা বা সারিঞ্জার ধুন। তাঁর এই বাদ্যযন্ত্র এখন লুপ্তপ্রায়। মেরেকেটে হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পীর হাতেই রয়েছে এটি।
ভাঙা ঘরে পদ্ম–সম্মান আসার পরে বদলেছে অনেক কিছুই। রাজবংশী উন্নয়ন পরিষদের তরফে পাকা ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। তবু ভাঙাচোরা সেই ঘরের মায়া আজও ছাড়তে পারেননি প্রবীণ শিল্পী। সেই ঘরের বেড়াতেই ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে সারিন্দা। পাশেই অজস্র মেডেল–স্মারক। হাসি মুখে তিনি জানালেন, কাঠের ঘরটিই তাঁর কাছে মন্দির। এই ঘরেই কেটেছে তাঁর শৈশব। তাই এই ঘর ছেড়ে অন্যত্র থাকতে ইচ্ছা হয় না তাঁর। পদ্মশ্রীপ্রাপ্তির পরে এখানেই উপচে পড়েছিল ভিড়। অনেকেই এসে দেখতে চেয়েছেন সারিন্দা নামে এই বাদ্যযন্ত্রটি। উত্তর দিতে দিতে তাঁর মাথার মধ্যে গুণগুণ করেছে একটাই প্রশ্ন, সারিন্দার ভবিষ্যৎ কী?
তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম সারিন্দা–বিমুখ। কে এগিয়ে আসবে সারিন্দাকে সংরক্ষণ করতে? কার হাতে খেলবে সারিন্দার সুর — এটাই সবসময়ে চিন্তা করি এখন।’
নতুন প্রজন্মের কথা বলতে বলতে হারিয়ে গেলেন ‘পুরোনো সেই দিনের কথায়’। জানালেন, ছেলেবেলায় গুরু ঘুমা কীর্তনিয়ার কাছ থেকে সামান্য ক’টি টাকায় এই সারিন্দাটি কিনেছিলেন। গুরুর কাছেও বহু দিন ধরে ছিল এটি। তাঁর দাবি, তাঁর হাতের এই বাদ্যযন্ত্রটির বয়স এখন প্রায় ২০০ বছর।
মঙ্গলাকান্তের স্ত্রী চম্পা রায় বলেন, ‘বিছানার পাশে মাথায় ওপরে ঝোলানো থাকে সারিন্দাটা। সকালে ঘুম থেকে উঠে সারিন্দা ছুঁয়ে আগে প্রণাম করেন। তার পরে হরিমন্দিরে যান। এর পরে দিন শুরু হয়।’ তবে আজকাল যে নতুন প্রজন্মের অনীহার কথা ভেবে মনমরা হয়ে আছেন, সে কথা জানাতে ভুললেন না স্ত্রী।
পদ্ম–সম্মানের আগে প্রাপ্তি বলতে বঙ্গরত্ন। পুরস্কারের টাকায় বাড়ির সামনে পুকুর ও বাগান সাজিয়েছেন শিল্পী। বাগানে গাছের ছায়ায় বসে রোজ সারিন্দা চর্চা করেন তিনি। সেই সুরের টানে ভিড় করেন গ্রামের বাসিন্দারা। সেই ভিড়ে কচি মুখ দেখলে, আশায় বুক বাঁধেন মঙ্গলাকান্ত। গাছের ছায়ায় সুরের মায়ায় চলতে থাকে খোঁজ। উত্তরসূরির...।