• কিডনি ইনজুরিতেই বাড়ছে প্রসূতি–মৃত্যু? সন্দেহের তির আইভি ফ্লুইডের দিকেও
    এই সময় | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি। সংক্ষেপে, একেআই। অর্থাৎ, আচমকা কিডনি বিকল হয়ে পড়া। আর সন্তান প্রসবের পর এই ঘটনা আজকাল ব্যাপক হারে, প্রায় তিন গুণ বেড়ে গিয়েছে রাজ্যে। স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর, ম্যাটার্নাল ডেথ অডিট কমিটির সদস্যরাও জানাচ্ছেন, কয়েক বছর হলো, এই সমস্যায় প্রসূতি মৃত্যুর নজিরও বেড়ে গিয়েছে।

    বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, এই একেআই সমস্যায় মেদিনীপুর মেডিক্যালে মামনি রুইদাস মারা যান জানুয়ারির ৯ তারিখে। আর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন নাসরিন খাতুন, মাম্পি সিং, মিনারা বিবি, রেখা সাউ-রা। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ, ইসলামপুর মহকুমা হাসপাতাল, বারুইপুর সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতালের প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনাগুলির নেপথ্যেও ছিল এই একেআই।

    বিশেষজ্ঞদের একাংশের সন্দেহ, রিঙ্গার্স ল্যাকটেট (আরএল), নর্ম্যাল স্যালাইন (এনএস), ডেক্সট্রোজ়-সহ নানা ধরনের ইন্ট্রাভেনাস বা আইভি ফ্লুইডের নিকৃষ্ট মানের জন্য এমন পরিণতি হচ্ছে না তো? সাম্প্রতিক অতীতের সব ক’টি ঘটনাতেই কাঠগড়ায় উঠেছে এই আইভি ফ্লুইড। এরই পাশাপাশি আবার আঙুল উঠছে অদক্ষ ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট নিয়েও। পরিস্থিতি ঘোরালো হচ্ছে এই দুইয়ে মিলেই। শুক্রবার স্বাস্থ্যভবনে সব মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে আয়োজিত ম্যাটার্নাল ডেথ অডিট কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

    চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ আইভি ফ্লুইডের গুণগত মান নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। কারণ, সমস্যাটা আগে তেমন ছিল না। কিন্তু বছর কয়েক হলো, একদিকে যেমন প্রসূতি মৃত্যুর হার বেড়েছে, তেমনই আবার তার নেপথ্য কারণ হিসেবে বেশি করে মাথাচাড়া দিয়েছে একেআই। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্যভবনের এক আধিকারিক বলেন, ‘সম্ভবত এই কারণেই প্রসূতি মৃত্যুর হারে অবনতি হয়েছে বাংলার। কারণ, প্রসূতি মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ একটা সময়ে ছিল প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ। কিন্তু সে সমস্যা এখন কমই। তার পরেও কেন এত মৃত্যু!’

    স্বাস্থ্যকর্তাদের অনেকেই মনে করছেন, ওই আধিকারিকের সন্দেহ অমূলক নয়। কারণ, গত কয়েক দশক ধরে লাগাতার উন্নতি করতে করতে ২০১৭-তে প্রথম বার প্রসূতি মৃত্যুর হার ১০০-র নীচে নামে পশ্চিমবঙ্গে। প্রতি লক্ষ প্রসবের ক্ষেত্রে মৃত্যুর নজির ১০১ (২০১৬) থেকে কমে দাঁড়ায় ৯৪-এ। কিন্তু ২০১৮-তে তা ফের বেড়ে গিয়ে হয় ৯৮। ২০১৯-এ প্রসূতি মৃত্যুর হার (১০৯) আরও অনেকটা বেড়ে যায়। যদিও ২০২০-র পরিসংখ্যান বলছে, এই সূচকে ফের উন্নতি হয়েছে বঙ্গের (১০৩)। যদিও তা জাতীয় গড়ের (৯৭) চেয়ে অনেকটাই বেশি। বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ, এই অবনতির নেপথ্যেও রয়েছে মূলত একেআই।

    প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন ফেডারেশন অফ অবস্টেট্রিক অ্যান্ড গায়নেকোলজিক্যাল সোসাইটিজ় অফ ইন্ডিয়া (ফগসি)-র এক পদাধিকারীর মতে, ‘আইভি ফ্লুইডের মান খারাপ হচ্ছে বলেই বেড়ে গিয়েছে একেআই-এর জেরে প্রসূতি মৃত্যু।’ তাঁর পর্যবেক্ষণে কার্যত সিলমোহরই দিচ্ছে স্বাস্থ্য দপ্তরের অভ্যন্তরীন ম্যাটার্নাল ডেথ অডিট কমিটি। তাঁদের তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩–এর ১ এপ্রিল থেকে ২০২৪-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাজ্যে যে ১১৬২ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে গর্ভাবস্থাকালীন উচ্চ রক্তচাপের (২০%) কারণে। আর কারণ হিসেবে তার পরেই রয়েছে সেপসিস (১৮%) এবং অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি (১২%)।

    অথচ কারণ হিসেবে আগে কখনোই ৫% টপকায়নি এই একেআই। বরাবরই ৩-৪% থাকতো এই কারণ। ওই ম্যাটার্নাল ডেথ অডিট কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘একদিকে ফ্লুইডের মান খারাপ, অন্যদিকে আবার ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টেও অদক্ষতার ছাপ। জোড়া ফলায় বাড়ছে কিডনি ইনজুরির জেরে প্রসূতিদের মৃত্যু।’ তিনি জানাচ্ছেন, এ রাজ্যে প্রসূতি মৃত্যুর নেপথ্যে যে মূল সাতটি কারণ চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে একমাত্র অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরির ক্ষেত্রেই অনেকটা অবনতি দেখা গিয়েছে। বাকি ছ’টি কারণে (গর্ভাবস্থাকালীন উচ্চ রক্তচাপ, সেপসিস, প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, লিভারের সমস্যা, অ্যানিমিয়া ও প্রসব-পূর্ববর্তী রক্তক্ষরণ) দেখা গিয়েছে উন্নতিই।

    বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইভি ফ্লুইডের মান যদি খারাপ হয়, তার জীবাণুমুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় যদি ঘাটতি থাকে, বোতলের মধ্যে যদি ছত্রাক বা ফাঙ্গাস জন্মায়, তা হলে সেই ফ্লুইড শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যে অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন রিঅ্যাকশন হবে, সেটাই কিডনির বারোটা বাজানোর জন্য যথেষ্ট।

    আবার গর্ভাবস্থাকালীন উচ্চ রক্তচাপ এবং সেপসিস থাকলেও তা কিডনির উপর ভয়ঙ্কর কুপ্রভাব ফেলে। তাতেও বাড়ে একেআই-এর নজির। এমনকী, নিম্নমানের ফ্লুইড থেকে সেপসিসও হয়। তবে এরই পাশাপাশি, আজকাল মেডিক্যাল কলেজ ও সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সংখ্যা অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় একেআই ডায়াগনসিসও হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। সব মিলিয়েই প্রসূতি মৃত্যুর পিছনে খলনায়কের ভূমিকায় থাবা চওড়া করছে কিডনির গোলমাল।

  • Link to this news (এই সময়)