বিশ্বরূপ বিশ্বাস, ইসলামপুর
ফাইট, কোনি ফাইট! সিনেমার পর্দায় ক্ষিদদার লড়াইটা ছিল যাবতীয় প্রতিকূলতার ঝড়ঝাপটা পার করে কোনিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছনোর রাস্তা করে দেওয়ার। আর বাস্তবের ক্ষিদদার লড়াইটা শুধু কয়েকশো কোনির জীবন গড়া নয়, হাজারো সামাজিক, অর্থনৈতিক বাধা অতিক্রম করে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকারও।
রুপোলী পর্দার ক্ষিদদার থেকেও বাস্তবের ক্ষিদদার লড়াইটা তাই আরও কঠিন। উত্তর দিনাজপুর জেলার গোয়ালপোখর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম নন্দঝাড়। গ্রামের স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে চন্দন পাল যখন গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘ফাইট গার্লস, ফাইট’, তখন তাতে ‘রি–টেক’–এর কোনও সুযোগ থাকে না। চন্দন বিলক্ষণ জানেন, একটাই জীবন, একটাই চান্স। আর জীবনটা সিনেমার পর্দা নয়। লড়াইয়ের মাঠ একবার ছেড়ে চলে গেলে ফিরে আসা অসম্ভব।
তবে নন্দঝাড়ের চন্দন পালের ‘ক্ষিদদা’ হয়ে ওঠার গল্পটা সিনেমাকেও হার মানায়। ২০০৬–এর কথা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে গ্রাম ছেড়ে শিলিগুড়ির কলেজে পড়তে যান চন্দন। হঠাৎ একদিন তাঁর নজরে আসে, কলেজ ক্যাম্পাসে মেয়েরা ফুটবল, ভলিবল খেলছে। চন্দনের মনে পড়ে গ্রামের কথা। কই তাঁর গ্রামের মাঠে তো মেয়েরা বল নিয়ে দাপাদাপি করতে পারে না!
অথচ অনেক মেয়েরই খেলাধুলোয় যথেষ্ট উৎসাহ। চিন্তাটা গেঁথে যায় মাথায়। কলেজের পাঠ চুকিয়ে ২০০৯–এ গ্রামে ফেরার পরে ২০১১–তে গোয়ালপোখরের চোপড়াবাখারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি জোটে। কিন্তু শিলিগুড়ির কলেজে মেয়েদের ফুটবল, ভলিবল খেলার দৃশ্যটা মাথার ভিতরে পাকাপাকি ভাবে বসে যায়।
প্রথম মাসের বেতন পেয়েই গ্রামের মেয়েদের নিয়ে দল গড়েন চন্দন। গ্রামের মানুষ হাঁ করে দেখে সেই আজব ঘটনা — মেয়েদের ফুটবল কোচিং সেন্টার! ইসলামপুর থেকে ফুটবল কোচের আসা–যাওয়া শুরু হয় নন্দঝাড়ে। খালি পায়ে মেয়েরা মাঠ দাপাচ্ছে। বলে লম্বা শট মারছে। আর পুরুষরা মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। একী কাণ্ড!
শুরু হয় গুঞ্জন। আড়াল–আবডাল থেকে ভেসে আসতে শুরু করে কটাক্ষ, ‘চন্দন মাস্টার কি কলিযুগের বিদ্যাসাগর? গ্রামে–গ্রামে তিনি মেয়েদের ফুটবল–স্কুল খুলতে চান নাকি!’ শুরু হয় ষড়যন্ত্র। শেষে গ্রামের মাঠে মেয়েদের ফুটবল কোচিং সেন্টার–এর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তবু হাল ছাড়েননি চন্দন। তিনি পাশের গ্রামের মাঠে নতুন ভাবে শুরু করেন মেয়েদের ফুটবল কোচিং সেন্টার।
এর মধ্যেই একদিন গোয়ালপোখর থানার এক অনুষ্ঠানে ফুটবল খেলার ডাক পেয়ে যায় নন্দঝাড়ের মহিলা টিম। প্রতিপক্ষর পায়ে বুট। কিন্তু তাতে কী! খালি পায়ে প্রতিপক্ষর পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার লড়াইটা এতদিনে রপ্ত করে ফেলেছে নন্দঝাড়ের মেয়েরা। আর সাইড লাইনের পাশে চন্দন স্যার তো আছেন–ই। চিৎকার করে বলছেন, ‘ফাইট গার্লস, ফাইট’।
এরপর উত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন থানার অনুষ্ঠানে ফুটবল খেলার ডাক পেতে শুরু করে চন্দন মাস্টারের মহিলা ব্রিগেড। গোয়ালপোখরের বিডিও রাজু শেরপা মহিলা ফুটবলারদের জুতো, বল ও জার্সির ব্যাবস্থা করে দেন। তাঁরই উদ্যোগে চন্দনের ফুটবল কোচিং–এর জুটেছে সরকারি স্বীকৃতি। যার নতুন নাম ‘নন্দঝাড় ছাত্র সমাজ’।
পরিসংখ্যান বলছে, ‘নন্দঝাড় ছাত্র সমাজ’ থেকে ১৭ জন মেয়ে সিভিক ভলান্টিয়ারের চাকরি পেয়েছেন। অনেকে রাজ্য পুলিশ, সিআরপিএফ, সিআইএসএফ–এও চাকরি করছেন। নন্দঝাড় গ্রামের নন্দিতা মণ্ডল, ফতেমা খাতুন, রাখি মণ্ডলরা সুব্রত কাপ–এ খেলার সুযোগও পেয়েছেন।
শুধু ফুটবল মাঠেই থেমে থাকেননি চন্দন। গ্রামের যে সব মেয়েরা ক্যারাটে, গান, নাচ ও আবৃত্তি শিখতে চায়, তাদের জন্য নিজের বাড়িতেই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এক সময়ে গ্রামে চন্দনের বিরোধীদের গলায় এখন উল্টো সুর। এক গ্রামবাসীর কথায়, ‘চন্দনকে চিনতে ভুল করেছিলাম। ও গ্রামের মুখ উজ্জল করেছেন।’ নন্দঝাড়ের চিত্ত পোদ্দার বলেন, ‘গ্রামের মেয়ে মানে অভিভাবকদের একটাই চিন্তা, ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিতে হবে। চন্দন আমাদের চিন্তায় পরিবর্তন এনেছে। নিজের চোখেই তো দেখেছি, গ্রামের কত দরিদ্র মেয়েদের মাঠমুখী করেছেন উনি।’
গোয়ালপোখরের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘চন্দন এবং ওঁর নন্দঝাড় ছাত্র সমাজের জন্য সব সময় আমার আশীর্বাদ আছে। আমি ওঁদের পাশে আছি।’ ইসলামপুর মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক কল্যাণ দাসের কথায়, ‘আমরা ওঁকে নিয়ে গর্ব করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস নন্দঝাড় গ্রামের মেয়েরা একদিন দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে।’
চন্দন ফিরে এসেছেন নন্দঝাড় গ্রামের পুরোনো মাঠে। যে গ্রামের মাঠে একদিন তাঁর ফুটবল কোচিং নিষিদ্ধ হয়েছিল, সে গ্রামে আজ একটাই আওয়াজ, ‘ফাইট চন্দন, ফাইট!’