কল্যাণীর স্কুলপাড়া লেনের বাজি কারখানা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পুলিশের দেওয়া চিঠিতেই ইঙ্গিত, রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বেআইনি বাজি কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে তেমন পদক্ষেপ করা হয়নি। তথ্য জানার অধিকার আইনে বা আরটিআই–তে পাঠানো প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ওই উত্তর দিয়েছে গত ২৯ জানুয়ারি। তার ঠিক ৯ দিন পরেই গত শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি কল্যাণীর ওই বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ, যাতে নিহত হয়েছেন ওই কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কর্মরত চার মহিলা।
তিনটি বিষয় জানতে চাওয়া হয়েছিল তথ্য জানার অধিকার আইনে বা আরটিআই–তে। এক, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গ্রিন ক্র্যাকার বা পরিবেশবান্ধব বাজি ছাড়া বাকি সব বাজি নিষিদ্ধ। কালীপুজোয় বাজি পোড়ানোর সময়সীমাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত— রাত ৮টা থেকে রাত ১০টা। সুপ্রিম কোর্টের রায় ও নির্দেশ নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? দুই, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কী পদক্ষেপ করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে বেআইনি বাজি নিয়ন্ত্রণে? তিন, নিষিদ্ধ বাজি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যারা ২০২৪ সালে আইন ভেঙেছে,তাদের কি চিহ্নিত করা হয়েছে? যদি হয়ে থাকে, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে থানায় বা আদালতে রুজু হওয়া মামলার সংখ্যা কত?
পরিবেশ, বন্যপ্রাণ ও বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা সংস্থা 'তারকেশ্বর গ্রিন মেট্স'–এর তরফে যুগ্ম সচিব শুভ্রকান্তি সামন্ত গত ১৪ ডিসেম্বর ওই সব প্রশ্নের উত্তর আরটিআই–তে জানতে চেয়েছিলেন রাজ্য পুলিশের কাছে।
তার উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স অর্থাৎ বেঙ্গল এসটিএফের ডিএসপি (সদর) এবং এসপিআইও (স্টেট পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার) ২৯ জানুয়ারির ওই চিঠিতে জানান— এক, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষকে নিষিদ্ধ বাজির কুফল ও বিপদ সম্পর্কে জানিয়ে তাঁরা যাতে বাজি না-কেনেন ও ব্যবহার না-করেন, সেটা বোঝানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি জেলায় স্কুল ও কলেজের পড়ুয়া এবং ক্লাবগুলোকে সামিল করে আয়োজিত কমিউনিটি প্রোগ্রামে সচেতন করা হয়েছে ছাত্রছাত্রী, যুব সমাজ ওবং অন্য সাধারণ মানুষকে। বাজির কুপ্রভাবের কথা উল্লেখ করে তৈরি হয়েছে ব্যানার ও লিফলেট। দুই, নিষিদ্ধ শব্দবাজির বিক্রিতে লাগাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেগুলো খুঁজতে ও বাজেয়াপ্ত করতে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ নিয়মিত অভিযান ও নাকা তল্লাশি চালাচ্ছে। উৎসবের মরশুমে প্রতিটি জেলায় সাধারণ মানুষকে নিষিদ্ধ বাজির ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে বলে ঘোষণাও করা হচ্ছে পুলিশের তরফে। তিন, ২০২৪ সালে নিষিদ্ধ বাজি ব্যবহারের ঘটনায় ৩১০টি মামলা রুজু করা হয়েছে।
কিন্তু পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, 'বেআইনি বাজি কারখানাগুলোই তো আসল বিপদ। সে রকম ক'টা কারখানার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা পুলিশ বলতে পারছে না। তা হলে সুপ্রিম কোর্টের রায় ও নির্দেশ মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হলো কোথায়? রাজ্য পুলিশের এই বক্তব্যের কথা আমি জাতীয় পরিবেশ আদালতে জানাব।' রাজ্যের বিভিন্ন বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু-মিছিলের কথা ও নিহতদের হিসেব তুলে ধরে ওই পরিবেশকর্মীই জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করেন। সেখানে পেশ করা নথিতে কল্যাণীর ঘটনা যুক্ত হলে ২০০৯ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছুঁই ছুঁই।