• বইমেলায় বাংলাদেশের অনুপস্থিতি বইপ্রেমীদের কি পীড়া দেয়নি?
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • সৈয়দ হাসমত জালাল

    শেষ হল কলকাতা বইমেলা। বলা ভালো, ৪৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। দীর্ঘকাল ধরেই এই বইমেলা বাঙালি জীবনের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এ এমনই এক মেলা, যেখানে প্রকাশকরা তো তাঁদের বিচিত্র ও বহুবিধ বইয়ের সম্ভার নিয়ে থাকেনই, সেই সঙ্গে থাকেন কবি, লেখক থেকে সম্পাদক এবং পাঠকেরাও। যাঁরা সারাবছর হয়তো কোনও বই কেনেন না, তাঁরাও সোৎসাহে বইমেলায় গিয়ে বিভিন্ন বইয়ের স্টলে ঘোরেন, বইও কেনেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালিরা অনেকেই শুধুমাত্র বইমেলার সময়েই কলকাতায় আসেন। মেলায় কয়েকটা দিন বই কিনে এবং পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যান। শুধু কবি, লেখকরাই নন, সংস্কৃতি জগতের অন্য শাখার মানুষেরাও ভরিয়ে রাখেন বইমেলাকে। প্রকৃত অর্থে এ এক অভূতপূর্ব মহাসম্মিলন।

    এবারের বইমেলার থিম কান্ট্রি ছিল জার্মানি। উদ্বোধনের দিন জার্মান রাষ্ট্রদূত ফিলিপ আকারমান এই বইমেলাকে ‘বইয়ের কুম্ভমেলা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই ‘কুম্ভমেলা’য় হারিয়ে যাওয়ার বা সঙ্গীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনাও কম ঘটতে দেখিনি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ দু-তিনটি বইমেলার অন্যতম এই কলকাতা বইমেলা। এই বইমেলায় পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্য ভাষার প্রকাশকদের বাইরেও থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বইয়ের স্টল। মনে পড়ছে, ১৯৭৮ সালের বইমেলার কথা। তখন বইমেলা হতো রবীন্দ্রসদনের উল্টো দিকের মাঠে। সেখানে বাংলাদেশের স্টলে পেয়েছিলাম কবি আল মাহমুদকে। ১৯৯৬ সাল থেকে নিয়মিত বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন থেকেছে এই বইমেলায়। বেশ কয়েকবার থিম কান্ট্রি হিসেবেও থেকেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রকাশক, লেখক ও কবি-সম্পাদকরাও এই মেলার বিশেষ অংশ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এবার কলকাতা বইমেলায় উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত ছিল বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নটি।

    কেন বাংলাদেশ এবার অনুপস্থিত, তা মেলার কয়েকদিন আগেই দিল্লিতে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এক সাংবাদিক বৈঠকে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় বর্তমান ‘ভূ-রাজনৈতিক’ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বইমেলায় যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সে কারণেই তাঁরা এবার বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানাননি। তবে একথাও তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের কোনও প্রকাশক যদি সরাসরি ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে মেলায় আসেন, তাতে গিল্ডের কোনও আপত্তি থাকবে না। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনও প্রকাশক সেভাবে আসেননি। এই সংবাদটি ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।

    কম বয়স থেকেই বইমেলায় বাংলাদেশের কবি-লেখকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, আলাপ-পরিচয় এবং আড্ডার অবকাশ ঘটেছে। শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন থেকে অসীম সাহা, নাসির আহমেদ, রেজাউদ্দিন স্টালিন প্রমুখ বহু প্রবীণ থেকে তরুণ বা নবীন কবি-লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি প্রতিবছরই। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে বই কিনতে ঢুকে বিপুল ভিড়ের কারণে অনেক সময় বই না কিনেই বেরিয়ে আসতে হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে ঢাকা যাওয়ার সুযোগ ঘটায় বাংলাদেশের সাহিত্যের বই পেতে তেমন অসুবিধে বোধ করিনি।

    ঢাকায় অনুষ্ঠিত ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী বইমেলায় যেমন গিয়েছি, আবার অন্য সময় আজিজ মার্কেট, পুরনো ঢাকার বাংলা বাজারেও গিয়েছি। ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেখানকার বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকেছি। আজিজ মার্কেট থেকে অধিকাংশ প্রকাশক উঠে গিয়েছেন কাঁটাবনে। সেখানেও কবি, লেখকবন্ধুদের সঙ্গে কম আড্ডা হয়নি। ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যের সঙ্গে একটি নিবিড় যোগসূত্র গড়ে উঠেছে বহুদিন ধরে।

    তাই স্বাভাবিকভাবেই এবার বইমেলায় বাংলাদেশের অভাব অনুভব করেছি বৈকি। এরকম আরও অনেকেই এই অভাব বোধ করেছেন। কারণ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কোনও একটি দেশের বেড়াজালে আটকে রাখা যায় না। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের কবি, লেখক, প্রকাশক বন্ধুরাও এবার আসতে না পেরে একইরকম বেদনা অনুভব করেছেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতির বাইরেও শিল্প-সাহিত্যের অন্য একটি স্থান রয়েছে। যে কোনও ভাষায় রচিত সাহিত্যই পৃথিবীর সব দেশের মানুষের কাছেই পৌঁছতে পারে, তার ভাবনার শরিক হতে পারে। মূল ভাষা জানা না থাকলেও অনুবাদের মাধ্যমে তার রসাস্বাদনে বাধা ঘটে না। আর আমাদের দুই বাংলার ভাষা তো একই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক– এঁরা কোন বাংলার, সে কথা আমাদের মনে থাকে না। তেমনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সমরেশ মজুমদার বাংলাদেশে কম জনপ্রিয় নন।

    ইদানিং কলকাতার সাহিত্যপ্রেমীরা অনেকেই বাংলাদেশের বই সম্পর্কে যথেষ্ট খোঁজখবর রাখেন। দুই দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের এই যোগসূত্র বেশিদিন ছিন্ন থাকবে বলে মনে করি না।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)