• ভালো মানুষ হও, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সন্তানদের বার্তা জেলবন্দি তিন বাবার
    বর্তমান | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • প্রদীপ্ত দত্ত, ঝাড়গ্ৰাম: কেউ দশ বছর, কেউ পনেরো বছর, কেউ কেউ তারও বেশি। ওদের সবার কিন্তু একটাই পরিচয়—জেলবন্দি। গারদের অন্ধকার কুঠুরি ওদের ঘরবাড়ি। সেখানেই ওরা স্বপ্ন দেখে, ছেলে-মেয়েরা ভালো হোক। পাড়াশোনা শিখে ভালো মানুষ হোক। বাবার বন্দি পরিচয় সন্তানদের জীবনে যেন প্রভাব না ফেলে। এমন চাওয়া অনেক বন্দিরই। তাদের মধ্যে তিনজনের সন্তান এবার মাধ্যমিক দিচ্ছে। দু’জনের ছেলে। একজনের মেয়ে। তাদের স্বপ্নপূরণে উৎকণ্ঠার শেষ নেই তিন বাবার। সোমবার ছিল মাধ্যমিকের প্রথম পরীক্ষা বাংলা। ছেলে-মেয়ের প্রস্তুতি নিয়ে ফোনে খোঁজখবর নিয়েছে। ফোনের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলার বিশেষ সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ। ছেলেদের দিয়েছেন একটাই বার্তা—‘ভালো করে পরীক্ষা দাও। বড় মানুষ হতে হবে তোমাদের।’ অশ্রুসজল তিন বাবা। আক্ষেপ শুধু, ছেলেদের জীবনের প্রথম পরীক্ষায় কেন্দ্রে যাওয়া হল না। কপালে চুম্বনের চিহ্নও এঁকে দেওয়া গেল না! 


    সেটাই স্বাভাবিক। তিন বাবারই বন্দিদশার সময় পেরিয়ে গিয়েছে দশকেরও বেশি। গারদে আসার আগে তাদের কারও ছেলে হয়তো হামাগুড়ি দিচ্ছিল। কারও ছেলে হয়তো অ-আ-ক-খ শিখছিল। কারও মেয়ে হয়তো প্রাথমিক স্কুলে পড়ছিল। তারা এখন পুরোদস্তুর কিশোর কিংবা কিশোরী। বন্দি বাবার পরিচয়ে তাদের বেড়ে ওঠা। বাড়তে বাড়তে আজ মাধ্যমিক পরীক্ষায়। জীবনের প্রথম ও বড় পরীক্ষা। ভবিষ্যৎ গড়ার পরীক্ষা। সেই পথে বাবার বন্দিদশার ছায়া পড়ুক, তা চান না তিনজনই। তাই ছেলে-মেয়েরা তাদের দেখতে চাইলে বারণ করে দিত পরিবারের লোকেদের। কিন্তু মন কী আর মানে? ছেলেরা কেমন পড়াশোনা করছে, কী খাচ্ছে, পরীক্ষাকেন্দ্র কোথায় পড়েছে, এসব জানতে মন উতলা থাকত সবসময়। তাদের এই ইচ্ছেপূরণে উজর-আপত্তি তোলেনি সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ। বরং সহযোগিতা করেছে। পরীক্ষার্থী ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে তারা। চালু করা হয়েছে তিনটি বুথ। নির্দিষ্ট সময়ে সেখান থেকে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেছে তিন বাবা। অ্যাডমিট কার্ড, পেন, বোর্ড ঠিকঠাকভাবে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তাতেই কয়েকদিনের অস্থিরতা কাটিয়ে বেশ খুশি তিনজনই। 


    বিশেষ সংশোধনগারে বন্দিদের যাবতীয় বিষয় সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হয়। প্রতি সপ্তাহে কাউন্সিলিংয়ের ব্যাবস্থা রয়েছে। নিরক্ষর বন্দিদের পঠনপাঠনের ব্যবস্থা চালু হয়েছে। অনেকেই সেখানে সামিল হচ্ছে। 


    জেলখানার একাধিক উৎসব-অনুষ্ঠানে বন্দিদের যোগদানেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এছড়াও বিশেষ বিশেষ দিনে ভালো খাবার-দাবার দেওয়া হয়।  আর্থিকভাবে দুর্বল বন্দিদের আইনজীবীর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সংশোধনগারের এক আধিকারিক বলেন, কয়েকদিন ধরেই তিন বন্দি সন্তানদের মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগে ছিল। গত শনিবার ওদের বাড়ির সঙ্গে ফোনে কথা বলার ব্যাবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। 


    ঝাড়গ্রাম বিশেষ সংশোধনগারের সুপারিনটেনডেন্ট রাজেশকুমার মণ্ডল বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া চলাকালীন বন্দিদের যে সব দাবি-দাওয়া রয়েছে, তা পূরণ করা হয়। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। তিন বন্দির মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। আমরাও আশ্বস্ত করেছি, ছেলেমেয়েরা ভালো করে পরীক্ষা দেবে। পরীক্ষার সাফল্য নিশ্চতভাবে তাদের উজ্জ্বল জীবনের পথ দেখাবে।’  


     গোপীবল্লভপুরে তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্যোগে পাঁচকাহানিয়া হাইস্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জলের বোতল ও পেন তুলে দেওয়া হচ্ছে। -নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)