মহম্মদ মহসীন, বাগনান
বাড়িতে আগুন লেগে ছাই হয়ে গিয়েছিল মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বাবা, কাকা। পরীক্ষার দিন কয়েক আগেই মাথার উপর থেকে চলে গিয়েছিল ছাদ। আগুনের হাত থেকে কোনও রকমে বেঁচে সে দিন রেনুকা খাতুনের প্রথম প্রশ্নই ছিল, ‘কী ভাবে পরীক্ষা দেব আমি?’
প্রশাসনের সহযোগিতায় সোমবার পরীক্ষায় বসতে কোনও অসুবিধে হলো না তার। মাধ্যমিকের প্রথম দিনে পরীক্ষা দিল নির্বিঘ্নেই। আর সেই পরীক্ষা চলাকালীন একবারের জন্যও জানতে পারল না, ইতিমধ্যেই হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে বাবার। এত দিন অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় জীবন–মৃত্যুর মাঝখানে লড়াই করছিলেন যিনি, মারা গিয়েছেন সেই রিয়াজুল আলম।
পরীক্ষা শেষের পরেও রেনুকাকে জানতে দেওয়া হয়নি এই মর্মান্তিক সত্য। গ্রামপ্রধান সস্নেহে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে তাকে এনে তুলেছিলেন নিজের বাড়িতে। যেন কিছুই ঘটেনি, এ ভাবে তাকে প্রস্তুত হতেও বলেছিলেন পরের দিনের পরীক্ষার জন্য। যদিও সোমবার শেষ সন্ধ্যায় রেনুকাকে জানানো হলো বাবার মৃত্যু সংবাদ।
গত বুধবার হাওড়ার বাগনান–২ ব্লকের হাল্যান গ্রামে এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে রেনুকাদের বাড়ি–সহ তার আত্মীয়দের মোট ছ’টি বাড়ি একেবারে ভস্মীভূত হয়ে যায়। গুরুতর ভাবে অগ্নিদগ্ধ হন রিয়াজুল, রেনুকার কাকা আক্তার আলি ও খুড়তুতো বোন ইসরানা পারভিন। তাঁদের কলকাতার বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বেঁচে যায় রেনুকা। আগুনের ঝাপটা যদিও তাকেও পুরোপুরি রেহাই দেয়নি। বাইরে থাকার কারণে বেঁচে যান রেনুকার মা রেহেনা খাতুনও। চিকিৎসা চলাকালীন স্বামীর কাছেই ছিলেন তিনি। রেনুকার পরীক্ষার দিনেও।
সোমবার রেনুকা যখন মাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষা দিচ্ছিল, তখন বাইরে তার গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান শেখ মাসিদুর রহমান ও পরিবারের বাকিদের কাছে রিয়াজুলের মৃত্যুর খবর আসে। তার আগে মা–বাবার আশীর্বাদ ছাড়াই কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল রেনুকা। কোচিং সেন্টারের শিক্ষক সুরজিৎ মাইতির বাইকে চেপে বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রুপাসগড়ি হাইস্কুলে পরীক্ষা দিতে যায়।
পরীক্ষার সাফল্য কামনা করে গ্রামপ্রধান মাসুদুর রেনুকার হাতে ধরিয়ে দেন একটি গোলাপ। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও রেনুকাকে তার অস্থায়ী ঠিকানায় না–পাঠিয়ে পাশের গ্রামে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান মাসুদুর রহমান। তখনও পর্যন্ত মারাত্মক এক টানাপড়েনের মধ্যে ছিলেন মাসুদুর ও তাঁর পরিবার। রেনুকাকে কি বলা যাবে, তার বাবার মৃত্যুর খবর? না কি তাঁরা অপেক্ষা করবেন অন্তত পরের দিনের পরীক্ষার জন্য? পরীক্ষা দিতে মরীয়া এই মেধাবী পড়ুয়াকে কি আর একটু সময় দেওয়া যায় না, যাতে সে জীবনের প্রথম পরীক্ষাটা উতরে যেতে পারে!
কিন্তু কোথাও একটা বিপদের আশঙ্কা টের পেয়ে গেল বুদ্ধিমতী মেয়েটি। কেন তাকে আনা হলো পাশের গ্রামের এই বাড়িতে? কেন সে ফিরল না তার কাকার বাড়িতে, নিজের বাড়ি পুড়ে যাওয়ার পরে যেখানে থাকছিল সে? অজানা আতঙ্কে কান্না শুরু করে রেনুকা। শেষ পর্যন্ত তাকে জানাতেই হলো কঠিন সত্যিটা। বাবা আর নেই।
মৃত রিয়াজুলের গ্রামে সোমবার সন্ধ্যায় সবাই অপেক্ষা করছিলেন, ময়নাতদন্তের পরে কখন দেহ বাড়িতে আনা হবে। সন্ধের পর বাড়ির সামনে শ’য়ে শ’য়ে লোক জড়ো হচ্ছিলেন। আর নিজের বাড়িতে মাসুদুর রেনুকাকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যাতে পরের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে বাধা না–পড়ে।
এলাকার কোচিং সেন্টারের প্রধান সুরজিৎ বলেন, ‘ওই পরিবারের সন্তানরা যতদিন পড়াশোনা করবে, সব রকম সহযোগিতা করে যাব। ’ আশ্বাস দিয়েছেন বাগনান–২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি প্রিয়জিৎ নন্দীও। হাতের চেটোয় চোখ মুছে আজ, মঙ্গলবার পরীক্ষা দিতে যাবে রেনুকা।