• বন দপ্তরের গাড়িতে জঙ্গলপথ পার, সেই অভিজ্ঞতাই লিখল পরীক্ষার্থীরা
    এই সময় | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • সব্যসাচী ঘোষ, মালবাজার

    জঙ্গলের পথ ওদের সাইকেলে চেপে পাড়ি দিতে হয়নি। ‘ফরেস্ট কাকু’রা গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছে পরীক্ষা কেন্দ্রে। যেতে যেতে জঙ্গল নিয়ে অনেক গল্পও শুনেছে ওরা। কী ভাবে পাহারা দিতে হয়, কতক্ষণ ডিউটির সময়, বনাঞ্চল বাঁচাতে কী কী করণীয়, এমনই নানা প্রসঙ্গ। আর পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পেতেই চমক! ১০ নম্বরের জন্য প্রবন্ধ লিখতে বলা হয়েছে, বন সংরক্ষণ এবং সময়ের মূল্য নিয়ে।

    কোনও টেনশন ছাড়াই সেটা লিখেছে ওরা। কারণ, প্রবন্ধের বিষয় যে পথে আসতেই তৈরি হয়ে গিয়েছে! গজলডোবা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র রাজদীপ বালু, ছাওয়াফুলির রাজীব ওঁরাও পরীক্ষা দিতে এসেছে চালসায়। সকলের অভিজ্ঞতা কমবেশি একই।

    পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে রাজীবের গলায় উচ্ছ্বাস, ‘আমার কোনও গৃহশিক্ষক নেই, প্রবন্ধ নিয়েও কোনও ধারণা ছিল না। এক বন্ধু বলেছিল অলিম্পিক আসতে পারে, তাই সেটাই একটু পড়ে এসেছিলাম। পথে ‘ফরেস্ট কাকু’রা বন সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের বোঝাচ্ছিল, সেটাই লিখে দিয়েছি খাতায়।’ রাজদীপের কথায়,‘বর্ষার আগে জঙ্গলে নানা গাছের বীজ ছেটানোর কাজ করেন ‘ফরেস্ট কাকু’রা। হাতি, গন্ডারদের চোরা শিকারের হাত থেকে বাঁচাতে রাতভর জঙ্গলে পাহারা দেন।আজ আসতে আসতে সেগুলোই গাড়িতে শুনলাম।’

    শুধু বন সংরক্ষণ নয়, সময়ের মূল্য প্রবন্ধেও পরীক্ষা কেন্দ্রের যাত্রার নির্যাস উঠে এসেছে উত্তরপত্রে। অ্যাডমিট কার্ড ভুলে বাড়িতে রেখে এসেছিল অনেকে, মোটরবাইকে চাপিয়ে তাদের পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছে পুলিশও। বিধান নগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা নন্দিনী ব্যাপারী বলে ওঠে, ‘মালবাজার যেতে নদী পেরোতে হয়, সেতু দিয়ে আসতে ঘুরতে হয় অন্তত ১০ কিলোমিটার। সাহায্য চাইতেই এক পুলিশকাকু মালবাজারের পুষ্পিকা স্কুলের কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়েছে। সময়ের মূল্য যে কতটা তা সেখান থেকেই বুঝে গিয়েছি,খাতায় লিখেছি–ও সেটা।’

    বেশকিছু বন বস্তিতে একদিন আগেই বন দপ্তরের পক্ষ থেকে গাড়ি করে পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল। সে রকমই গোরুমারা লাগোয়া সুরসুতি বন বস্তির এক ছাত্রের কথায়, ‘সাইকেল চালিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে দেড় ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বেরোতে হতো, গাড়ি চেপে আসায় শেষ মুহূর্তে বইয়ে চোখ বোলানোর অতিরিক্ত সময় পেয়েছি।’

    ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়াই শুধু নয়, উত্তরপত্রের খাতা ভরাতেও যে তাদের পরোক্ষ সাহায্য ছিল তা জেনে বেজায় খুশি বন ও পুলিশকর্তারা।

    জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার উমেশ গণপথ খন্ডবহালে বলেন, ‘সব স্তরের পুলিশকে পথে থাকতে বলা হয়েছিল, কোনও সমস্যা হলেই পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া ছিল। সময়ের মূল্য যে ওরা বুঝেছে তাতে আমরাও খুশি।’

    উল্লেখ্য, জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম ও বনবস্তিগুলোতে এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা অনেকেই প্রথম প্রজন্মের। তাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। ফলে গৃহশিক্ষক দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। সরকারি গাড়িতে সন্তান পরীক্ষা কেন্দ্রে যাচ্ছে এতেই আহ্লাদিত অভিভাবকরা। তার ওপর পরীক্ষা ভালো হওয়ায় বাড়তি খুশি যোগ হয়েছে। খরিয়ার বন্দর জঙ্গল লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা পার্বতী রায়। তিনি একটি সরকারি স্কুলে মিড ডে মিল রান্না করেন। ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘ছেলে বড় হয়ে কোনও একদিন গাড়ি চেপে অফিসে যাবে সেই স্বপ্ন দেখি, কিন্তু সরকারি গাড়িতে চেপে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে যাবে সেটা কখনও ভাবিনি।’

  • Link to this news (এই সময়)