• বিজেপি নেত্রীর চলচ্চিত্র উৎসবে সিপিএম নেতার ছবি! টলিউড পরিস্থিতি কি নৈকট্য বাড়াচ্ছে দু’পক্ষের
    আনন্দবাজার | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • ভারতের রাজনীতিতে এই দু’দল পরস্পরের সবচেয়ে বড় ‘শত্রু’! বামপন্থীদের অনেকেই বিজেপি-আরএসএসকে ‘শত্রু’ (‘প্রতিপক্ষ’ নয়) বলেই সম্বোধন করে থাকেন। যে ভাবে আরএসএস-বিজেপি বামপন্থাকেই সবচেয়ে বড় ‘বিপদ’ বলে দাগিয়ে দেয়। রাজনৈতিক বিষয়-বিশেষে দু’দল এক সুরে কখনও কখনও তৃণমূলকে আক্রমণ করলেও সাংস্কৃতিক পরিসরে পরস্পরের কাছাকাছি আসা বিরল। পশ্চিমবঙ্গ তেমনই এক বিরল ঘটনার সাক্ষী হতে চলেছে। বিজেপি নেত্রীর উদ্যোগে চলচ্চিত্র উৎসবে নিজের তৈরি ছবি নিয়ে হাজির হচ্ছেন সিপিএম নেতা।

    সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে (এসআরএফটিআই) ১৫ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত হচ্ছে ‘বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। উদ্যোক্তা সংগঠনের নাম ‘বাংলা আবার’। সংগঠনের মূল নিয়ন্ত্রক সংঘমিত্রা চৌধুরী কলকাতায় বিজেপির পরিচিত মুখ। দক্ষিণ কলকাতা জেলা বিজেপির সভানেত্রীও ছিলেন। তাঁর উদ্যোগ বলেই সম্ভবত ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক এবং এনএফডিসি-ও শামিল হয়েছে এ উৎসবে। কিন্তু অনেকেই বিস্মিত ওই উৎসবে সিপিএম নেতার অংশগ্রহণে। তিনি আবার এমন এক জন, যিনি বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের হয়ে লড়েছেন। নাম দেবদূত ঘোষ। অভিনেতা তথা চলচ্চিত্র নির্মাতা। যে চলচ্চিত্র উৎসবে ‘স্বতন্ত্র বীর সাভারকর’ বা ‘দ্য সবরমতী রিপোর্ট’-এর মতো ছবি দেখানো হবে, সেখানে দেবদূতের নির্দেশনায় তৈরি ‘আদর’ও প্রদর্শিত হবে।

    উৎসবে চার দিনে ১০টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি দেখানো হবে। এ ছাড়াও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি, শিশুদের জন্য তৈরি ছবি ইত্যাদি থাকবে ২৫টি। সিপিএম নেতা দেবদূতের তৈরি ছবিটি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘আদরিনী’ অবলম্বনে তৈরি। মানুষ এবং প্রকৃতির নিবিড় আদান-প্রদানের আখ্যান ছবির বিষয়। অর্থাৎ, চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজক বিজেপি নেত্রী সঙ্ঘমিত্রার জন্য এই ছবি কোনও ‘আদর্শগত অস্বস্তি’ ডেকে আনছে না। কিন্তু যে সাভারকরকে সিপিএম ধারাবাহিক আক্রমণ করে এসেছে, তাঁর মাহাত্ম্যকীর্তনে তৈরি ছবিও এই উৎসবে থাকছে। গুজরাতে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রসঙ্গে সিপিএমের বক্তব্যের বিপরীত বক্তব্য তুলে ধরা ছবিও উৎসবে থাকছে। তাঁর ছবি ‘আদর’কে নিয়ে সেই আসরে যেতে দেবদূতের অস্বস্তি হবে না?

    দেবদূতের বক্তব্যে অস্বস্তির কোনও আভাস নেই। তিনি বিতর্কেরও পরোয়া করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘শিল্পে বা চলচ্চিত্রে কোনও ভাগাভাগি হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না। বিজেপি সমর্থক, আরএসএস সমর্থক, তৃণমূল সমর্থক, সিপিএম সমর্থকের জন্য আলাদা আলাদা ছবি হয় না। ছবি সকলের জন‍্য। আমি শুধু বামপন্থী দর্শকের জন‍্য ছবি বানাব বা কেউ শুধু বিজেপি সমর্থকদের জন‍্য ছবি বানাবেন, এমন হয় না। ছবি সকলের জন‍্য বানানো হবে এবং সব রকমের ছবিই উৎসবে আসবে। দর্শক বেছে নেবেন, কোনটা দেখবেন, কোনটা পছন্দ করবেন।’’

    গত ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে টালিগঞ্জ আসন থেকে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন দেবদূত। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনেও ব্যারাকপুরে সিপিএম প্রার্থী ছিলেন। সিপিএম কি মনে করে যে, শিল্প-সংস্কৃতি বা চলচ্চিত্রে ভাগাভাগি হয় না? ক্ষমতাসীন সিপিএমের আমলে কি সাংস্কৃতিক পরিসরে ‘আমরা-ওরা’ হয়নি? দেবদূত সে কথা পুরোপুরি মানছেন না। আবার পুরোপুরি অস্বীকারও করছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার কারণে কারও কারও আচরণে দম্ভ দেখা যাচ্ছিল, এ কথা অস্বীকার করব না। সাংস্কৃতিক পরিসরেও তার ছাপ পড়েছিল। চোখরাঙানির সংস্কৃতিতে কেউ কেউ হয়তো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সরকার অনেক সহনশীল ছিল। এবং সেই সহনশীলতা শেষ মুহূর্ত পর্যন্তই যে ছিল, তা-ও আমি সচেতন ভাবেই বলছি।’’

    ব্রাত্য বসুর ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’-এর প্রদর্শন আটকে দেওয়া প্রসঙ্গে মন্তব্য করছেন না দেবদূত। তবে অর্পিতা ঘোষের ‘পশুখামার’ দেখাতে না দেওয়ার প্রসঙ্গে বলছেন, ‘‘দলের কেউ ওই নাটকের প্রদর্শন আটকাননি। নির্বাচন ঘোষিত হয়ে যাওয়ার পর এমন শো হলে তার সারমর্ম মহকুমা প্রশাসন বা জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হয়। বাঁশবেড়িয়ায় অর্পিতারা যখন ওই শো করতে চেয়েছিলেন, তখন স্থানীয় প্রশাসন সারমর্ম জানতে চেয়েছিল। কিন্তু দোষটা চাপানো হল সেখানকার তৎকালীন সাংসদ রূপচাঁদ পালের উপরে। বুদ্ধদেব ভট্টচার্য ওই ঘটনায় অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন বলে সাংসদকে ক্ষমাও চাইতে হয়। কিন্তু ওই ঘটনায় সত্যিই সাংসদের কোনও ভূমিকা ছিল না।’’

    ঘটনাচক্রে, বিজেপির সঙ্ঘমিত্রা এবং সিপিএমের দেবদূত শুধু উৎসবে মিলছেন না, রাজনৈতিক সুরেও কিছুটা মিলে যাচ্ছেন। দেবদূত বলছেন, ‘‘বাংলা ছবির স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে আমাদের এই ভাগাভাগি বন্ধ হওয়া উচিত।’’ সঙ্ঘমিত্রা বলছেন, ‘‘টালিগঞ্জে এই মুহূর্তে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে বাংলা ছবির স্বার্থে, টেলিভিশনের স্বার্থে আমাদের এক হওয়া দরকার।’’

    তা হলে কি টলিউড-টেলিউডের বর্তমান পরিস্থিতিই বিজেপি-সিপিএমকে কাছাকাছি আনছে? সঙ্ঘমিত্রা অকপটে বলছেন ‘‘কিছুটা তো সে রকমই।’’ তবে দেবদূত এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিচ্ছেন না। তিনি বলছেন, ‘‘আমি চাই, যাঁরা ইন্ডাস্ট্রির লোক, ইন্ডাস্ট্রির নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে থাক। বাইরের লোকের হাতে ইন্ডাস্ট্রির নিয়ন্ত্রণ থাকার বিরোধিতাই আমি করি।’’

  • Link to this news (আনন্দবাজার)