রাকিব ইকবাল, শ্যামপুর
‘....মোমের পুতুল ঘুমিয়ে থাকুক দাঁত মেলে আর চুল খুলে, টিনের পুতুল চীনের পুতুল, কেউ কি এমন তুলতুলে?...’ কবির এই ‘আদুরে পুতুল’ কবিতার মতোই মোমের পুতুল, টিনের পুতুল, দেশ–বিদেশের আর কতই না পুতুলে ভরা সংসার অমলেন্দুর। পুতুল দেখতে ভিড় জমাচ্ছে কচিকাঁচা স্কুল পড়ুয়ার দল।
হাজারের বেশি পুতুল স্হান পেয়েছে অমলেন্দুর সংসারে। অমলেন্দুর আক্ষেপ, ‘এখন আর কচিকাঁচারা পুতুল খেলে না। স্মার্টফোন কেড়ে নিচ্ছে তাদের শৈশবের আনন্দ। কবে যে আবার শিশুদের পুতুল খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়বে!’
হাওড়া গ্রামীণের শ্যামপুর থানা এলাকার কালীদহ গ্রামে নিজের বসতবাড়িতে ৬৬০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন মায়াচর হাইস্কুলের শিক্ষক অমলেন্দু বেরা। সংগ্রহশালার নাম রেখেছেন, ‘তীর্থবতী গ্রামীণ সংগ্রহশালা।’ তিন বছর পার করেছে তাঁর এই সংগ্রহশালা। তবে শুরুটা হয়েছিল ২০০৭ সালে। আঞ্চলিক ইতিহাসের ক্ষেত্র সমীক্ষা করার কাজের সুবাদে দূর–দূরান্তে ছুটে যেতেন অমলেন্দু। তখন থেকেই একটা একটা করে নিজের সংগ্রহের ঝুলি হরেক পুতুল দিয়ে ভরাতে শুরু করেন অমলেন্দু। এখন তাঁর পুতুলের সংগ্রহ–সংখ্যা হাজার পার করেছে।
শুধু যে সংগ্রহশালা হরেক রকম পুতুলে ভরেছে, এমনটা নয়। সংগ্রহশালায় স্হান পেয়েছে হরেক রকম দারুশিল্প, টেরাকোটা, হুঁকো, কুটুম কাটাম, তৈলচিত্র, বিভিন্ন জেলার লক্ষ্মী ও গণেশের ঘট, পাই-কুনকে, বিভিন্ন জেলার ছলনের হাতি–ঘোড়া— আরও কত কী! তবে তাঁর সংগ্রহে সব থেকে বেশি নজর কাড়ে চোখধাঁধানো পুতুলের সমাহার। অমলেন্দু জানান, আগেকার দিনে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। মেয়ে যখন শুশুরবাড়ি যেত, তখন তার হাতে বিভিন্ন সামগ্রীর সঙ্গে দেওয়া হতো একটি হিঙ্গুল পুতুল।
কারণ, সে শশুরবাড়ি গিয়ে এই পুতুল নিয়ে খেলতে পারবে। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে এই হিঙ্গুল পুতুল তৈরি হয়। তবে শুধু যে এই হিঙ্গুল পুতুল রয়েছে অমলেন্দুর সংগ্রহে, তা নয়। দীর্ঘ তালিকায় রয়েছে ওডিশার রঘুরাজপুরের কাগজের মণ্ডের পুতুল, ডোকরার কাজের পুতুল, মুখোশ। রয়েছে ঝাড়খণ্ডের মাটির দেওয়ালি পুতুল, তেলঙ্গানা ও কর্নাটকের কাঠের পুতুল, রাজস্থানের কাপড়ের তৈরি পুতুল, আসামের শিং থেকে তৈরি পুতুল, রয়েছে বাংলাদেশের দেওয়ালি পুতুল, চিনের মার্বেল ডাস্ট থেকে তৈরি পুতুল, মিশরের পিতলের তৈরি পুতুল, মমি পুতুল, শেয়াল দেবতার মূর্তি, প্যাপিরাস দিয়ে তৈরি পুতুল, ঘানার কাঠের তৈরি মুখোশ, তুরস্কের গান–বাজনা পরিবেশনরত পুতুল।
এই রাজ্যের আনাচ–কানাচ ঘুরে একটু একটু করে পুতুল সংগ্রহ করে এনেছেন অমলেন্দু। সেই তালিকায় রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের দেওয়ালি পুতুল, পূর্ব মেদিনীপুরে জো পুতুল, বর্ধমানের কাঠের পুতুল, পটাশপুর, এগরার গালা দিয়ে তৈরি পুতুল, পশ্চিম মেদিনীপুরের গরু–মহিষের সিং দিয়ে তৈরি পুতুল, জয়নগর মজিলপুরের ছাঁচের তৈরি হরেক রকম পুতুল, কৃষ্ণনগরের পুতুল। দিনাজপুরের পুতুল, হাওড়ার রানি পুতুল, টেপা পুতুল, বর্ধমানের নতুন গ্রামের পুতুল।
পুতুল সংগ্রহ করতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বাইক নিয়ে ছুটে গিয়েছেন অমলেন্দু। তিনি বলেন, ‘যখনই কোথাও কোনও নতুন পুতুলের খবর পাই, ছুটে গিয়ে তা সংগ্রহ করে আনি।’ পুতুল সংগ্রহ করতে কখনও আবার বাইক নিয়ে ছুটে গিয়েছেন ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, বিহারেও।
কিন্তু কী জন্য এই এত কষ্টে পুতুল সংগ্রহ?
অমলেন্দু বলেন, ‘তিল তিল করে জমা করা এই সংগ্রহকে সবার সামনে তুলে ধরতে, বিশেষ করে শিশুদের হারিয়ে যাওয়া খেলার সঙ্গী পুতুলগুলির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে আমি তিন বছর আগে বাড়িতেই সংগ্রহশালা তৈরি করেছি। একটা সময় ছিল, যখন এই পুতুলই ছিল আমাদের খেলার সঙ্গী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুতুল খেলা হারিয়ে ফেলেছে শিশুমন। মনের জায়গা জুড়ে বসেছে স্মার্টফোন। মোবাইল আসক্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা।’
তাঁর মতে, এখনকার শিশুরা পুতুল কী, তা–ই জানে না। তাঁর এই সংগ্রহশালার লক্ষ্য হলো, শিশুদের কাছে তাদের মা–ঠাকুমার আমলের নির্মল শৈশব ফিরিয়ে দেওয়া। তারা যেন মোবাইলের রিলস্–এ বন্দি না থেকে বেরিয়ে আসে মুক্ত পরিবেশে, বাস্তবে। অমলেন্দুর স্বপ্ন, শিশুদের বাড়ির বারান্দায়, উঠোনে, তাদের খেলাঘরে জায়গা করে নিক রানি পুতুল, জো পুতুল, মাতৃয়োস্কা পুতুলেরা