সব্যসাচী ঘোষ ■ মালবাজার
এক বাংলোয় বড়বাবু বসে আছেন ইজ়িচেয়ারে। ভিতরে ফায়ার–প্লেসে আগুন জ্বলছে। কাঠ পোড়ার মচমচ শব্দ। এই আইকনিক দৃশ্য অনেক ছবিতেই ঘুরেফিরে এসেছে। যেমন শক্তি সামন্তের 'অনুসন্ধান'। আশির দশকে সেবকের কাছে মংপং লাগোয়া চা বাগানে শুটিং হয়েছিল এই ছবির। 'অনুসন্ধান' বাঙালির চিরকালীন চর্চার অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে নিভে এসেছে সেই ফায়ার–প্লেস।
কনকনে শীত আর সে রকম পড়ে না। দু'একদিন ব্যাটিং করে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। ফলে ঘরের কোণে অগ্নিকুণ্ডের ওম আর প্রয়োজন হয় না। বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া সেই ফায়ার প্লেসগুলো এখন কিন্তু মাঝেমধ্যে জরুরি হয়ে উঠছে। তাপমাত্রার ওঠাপড়ায় এ বার ডুয়ার্সের পারদ যতটা নেমেছে, তার থেকে বেশি শীত অনুভূত হয়েছে পশ্চিমি ঝঞ্ঝার জন্য। কয়েকদিনের বিরতিতে আবার মঙ্গলবার থেকে শীত বাড়ছে।
সিকিমের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া আধিকারিক গোপীনাথ রাহা জানিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহ শীতের প্রকোপ বাড়বে। পাহাড় ও ডুয়ার্স জুড়ে শীতের প্রাবল্যের সঙ্গে বৃষ্টির পূর্বাভাসও থাকছে। মঙ্গলবার দুপুর থেকেই সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কালিম্পং ও লাগোয়া পাহাড়েও বৃষ্টি নামা সময়ের অপেক্ষা। ফলে প্রবল ঠান্ডার সঙ্গে বৃষ্টিও থাকবে উত্তরবঙ্গে। তাই ফের জ্বলে উঠছে ফায়ার প্লেস।
ডুয়ার্সের শতবর্ষ পুরোনো সাহেব আমলের চা–বাগানে ম্যানেজারের বাংলোয় রয়েছে ফায়ার–প্লেস। অব্যবহারে তার লোহার জালিতে মরচে ধরে গিয়েছিল। ধোঁয়া বার হওয়ার চিমনির মুখও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আবর্জনায়। সে সব দ্রুত সারাই করে ফেলেছেন চা–বাগানের ম্যানেজারেরা। শুকনো কাঠ দিয়ে বিকেলেই ফায়ার–প্লেসের আগুন সেজে দিচ্ছেন বেয়ারারা। তার পাশে সকলে জড়ো হচ্ছেন, শীতের তীব্রতা পরিবারের সকলকে কাছাকাছি এনে দিচ্ছে। একশোর বেশি বাগানের বাংলোয় আবার উদয় হয়েছে ফায়ার–প্লেসের। উষ্ণতার সঙ্গে এই অগ্নিকুণ্ড ছড়িয়ে দিচ্ছে স্মৃতির আবেশও।
সুভাষিণী চা–বাগানের ম্যানেজার ছিলেন অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। রাগাশ্রয়ী ছুঁয়ে তাঁর আড্ডা পৌঁছে যেত এভারেস্ট আরোহণের গপ্পে। কলকাতার তাবড় সাহিত্যিক থেকে সংগীতজ্ঞ, অনেকেই তাঁর সান্ধ্য আড্ডায় যোগ দিতেন। ৮০–৯০–এর দশকে সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের ফায়ার–প্লেসে উষ্ণ আড্ডা আজও স্মৃতি হয়ে আছে। কখনও উদাত্ত গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন সাগর সেন। এ সবের সাক্ষী ফায়ার প্লেস। শীর্ষেন্দু বলেন, 'শৈশবে যে সব রেল কোয়ার্টারে থাকতাম, তার সবগুলোতেই ফায়ার–প্লেস ছিল। কিন্তু সেগুলো তেমন ব্যবহার হতো না। সুভাষিণী চা বাগানের আড্ডা আমার মনে আছে, মনে পড়ে ঘুম লাগোয়া কোনও এক সরকারি বাংলোর ফায়ার–প্লেসের আড্ডার কথাও।'
ওয়াশাবাড়ি চা বাগানের ম্যানেজার রাজকুমার মণ্ডল বহু বছর পরে ফায়ার–প্লেসে আগুন ধরিয়েছেন। এ বার শীতের কামড় একটু বেশিই যে! বলেন, 'আমাদের জন্য এই শীত ভীষণ দরকার, ফায়ার প্লেসে আগুনের শিখা জ্বলছে দেখে আনন্দ হচ্ছে। ডুয়ার্স ডুয়ার্সেই আছে।' বেতগুড়ি চা বাগানের ম্যানেজার মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য বলেন, 'আমাদের ফায়ার প্লেস খারাপ হয়ে পড়েছিল। রাতারাতি সারাই করে চালু করে দেওয়া হয়েছে।'
মহালয়ার আগে যেমন কথা হারিয়ে ফেলা বেতারে প্রাণ ফেরে, তেমনই এই শীতে ফিরে এসেছে ফায়ার–প্লেস। ফিনিক্স পাখির মতো।