প্রবীর কুণ্ডু ■ তুফানগঞ্জ
‘হস্তে নিয়া আমরা চাইলন বাতি, চাইলন বাতি, বরণ বরি আমরা অতিথি।’ লোকগানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করতে লজ্জা পেতেন গ্রামের মহিলারা। ভয় একটাই, এ ভাবে কোমর দুলিয়ে নাচলে লোকে কী বলবে? গ্রামে গ্রামে ঘুরে, মহিলাদের বুঝিয়ে, তাঁদের বদ্ধ ধারণা ভেঙে বৈরাতি নাচের দল গড়েছেন তুফানগঞ্জের মনিকা। নাম দিয়েছেন কৃষ্টি। কোচবিহারের তুফানগঞ্জ পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়িই এখন তাঁর চর্চাকেন্দ্র। প্রায় ৩০ বছর ধরে বৈরাতি গান ও নাচকে ঘিরে দেখা স্বপ্ন অবশেষে সফল হয়েছে।
তিন দশকের লড়াই বিফলে যায়নি। সুনামের মুখ দেখেছেন শিল্পীরা। গ্রাম থেকে জেলার গণ্ডি পেরিয়ে রাজবংশী শিল্পী মনিকা অধিকারী ও তাঁর দলের নাম ছড়িয়েছে কলকাতায়। পনেরো জনের দলে রয়েছেন সরোজিনী, সান্ত্বনা, সুভদ্রাদের মতো রাজবংশী পরিবারের মহিলারা৷ তবে এখন নিজে বৈরাতি নাচে অংশ না নিলেও, তাঁর দলের অনুষ্ঠানে তিনিই সুর তোলেন। দলের বাকিরা সেই ছন্দে নৃত্য পরিবেশন করেন। সকলের হাতে থাকে প্রদীপ ও ফুল দিয়ে সাজানো চালুনি। প্রত্যেকের গলায় ও কোমরে থাকে হলুদ গামছা।
বৈরাতি একটি রাজবংশী লোকগান। রাজবংশী জনজাতির যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে এই গানের মাধ্যমেই করা হয় অতিথি বরণ। মূলত বিয়েবাড়িতে এই বৈরাতি গান ও নাচের মাধ্যমে বরণডালা হাতে বরযাত্রীকে স্বাগত জানাতেন তাঁরা। সেই হারিয়ে যেতে বসা সংস্কৃতি ধরে রাখতেই এই উদ্যোগ নিয়েছেন মনিকা৷ শিল্পীর কথায়, ‘উত্তরবঙ্গজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার বৈরাতি নাচের দলের ডাক আসে। কলকাতার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রণ পেয়েছি বেশ কয়েকবার।’
তাঁর সংযোজন, ‘ছোটবেলায় যখন এই নাচের চর্চা করতাম, পাড়াপড়শিরা বাঁকা চোখে দেখতেন। কিন্তু তাতে পরোয়া করিনি কখনও। শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতেই নৃত্যচর্চা চালিয়ে গিয়েছি। এই রাজবংশী সংস্কৃতি আমি কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেব না’। পরিবারের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। স্বামী বাবলু সরকার বলেন, ‘আমি সব সময়ে ওকে উৎসাহ দিয়ে এসেছি। রাজবংশী এই সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে ওঁর মতো আরও অনেককেই এগিয়ে আসতে হবে৷’
২০০৬ সালে রাজ্য ভাওয়াইয়া উৎসবে প্রথম হয়েছিলেন মনিকা। তুফানগঞ্জের বাড়িতেই চলে বৈরাতি গান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা। তাঁর কথায়, ‘জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই বৈরাতি নৃত্যকে ঘিরেই বাঁচতে চাই।’