• মধ্যবিত্ত-মহিলা-গ্রাম বিকাশে মমতার ছোঁয়া
    এই সময় | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়: সংস্কারের কোনও ঘোষণা নয়। রাজ্যের আর্থ–সামাজিক উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বাজেটে গ্রামোন্নয়ন–মধ্যবিত্ত–নারী ও শিশু কল্যাণকেই অভিমুখ করল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

    বুধবার রাজ্যের অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছেন, চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে রাজ্য সরকারি কর্মীদের জন্য ৪% অতিরিক্ত ডিএ দেওয়া হবে। এতে রাজ্যের চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশের অবশ্যই সুরাহা হবে বলে মত অর্থনীতি বিশ্লেষকদের বড় অংশের। সরকারি, আধা–সরকারি কর্মী, শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী এবং পেনশনভোগী মিলিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ এতে উপকৃত হবেন।

    গ্রামোন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকাঠামো নির্মাণকেও অগ্রাধিকার দিয়েছে রাজ্য। এ দিন বিধানসভায় ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্য পেশ করা বাজেটে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১৬ লক্ষ অতিরিক্ত যোগ্য পরিবারকে বাসস্থান দিতে ৯,৬০০ কোটি টাকার বরাদ্দ করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে রাস্তা তৈরি করতে ‘পথশ্রী’ প্রকল্পে ১,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা করেছেন চন্দ্রিমা।

    তিনি জানিয়েছেন, ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ প্রকল্প আগামী দু’বছরের মধ্যে শেষ হবে এবং তার জন্য মোট ১,৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এ জন্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা তিনি বরাদ্দ করেছেন। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাজেটে মোট প্রস্তাবিত ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক মহিলা ও কন্যা সন্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।

    পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই বাজেটে ভবিষ্যতের জন্য একটি ভিশন রয়েছে। এই বাজেট কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। প্রান্তিক চাষি, গ্রামীণ মানুষ, ঘরের মেয়েরা, ছোট ভাই–বোনেরা, শিক্ষার্থী সকলের জন্যই এই বাজেট এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে চিরকাল তাঁদের কারও কাছে যেন হাত পাততে না–হয়। উন্নতির সেতুবন্ধন করা হয়েছে।’ যদিও মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য খারিজ করে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, ‘এই বাজেটে যা প্রতিশ্রুতি, তা ২০২৬ ভোটের আগে পালন করা সম্ভব নয়। এই বাজেটে নারী সুরক্ষার কথা নেই। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিধবা ভাতা বৃদ্ধির কথাও নেই।’

    রাজনৈতিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটে মধ্যবিত্ত ‘ফ্যামিলিম্যান’–এর দিকে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন নির্মলা সীতারামন। আর রাজ্যের বাজেটে মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি মূলত গ্রামীণ এলাকার উন্নয়ন এবং মহিলা–শিশু বিকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হলো। আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে গ্রামীণ উন্নয়নে এই বরাদ্দ কতখানি মাইলেজ দেয় রাজ্যের শাসকদলকে, সেটাই দেখার।

    ‘নদী–বন্ধন’ নামে একটি নতুন প্রকল্পের আওতায় বাজেটে বিভিন্ন নদীর মধ্যে এবং নদী ও জলাভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে সাধারণ মানুষের জন্য নানাবিধ জীবিকা সংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে বলে জানিয়েছে সরকার। এ জন্য বাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। নদী ভাঙন রোধে মাস্টার প্ল্যান তৈরি করার জন্য বাজেটে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন চন্দ্রিমা। গঙ্গাসাগর সেতু চার লেন করতে ৫০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হয়েছে। ৭০ হাজার আশা কর্মী ও ১ লক্ষের বেশি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে স্মার্ট ফোন দিতে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করার প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে।

    তবে এত কিছু খাতে বরাদ্দের টাকা কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশেষজ্ঞ মহল। কারণ, এ বারের বাজেটে উল্লেখিত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের সংশোধিত হিসেবে রাজ্যের নিজস্ব কর সংগ্রহ পূর্বাভাসের তুলনায় প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা কমে হয়েছে ৯৯,৮৬৩.১৬ কোটি টাকা। আবগারি খাতে রাজস্ব আদায় পূর্বাভাসের তুলনায় ১,৪০০ কোটি টাকা কমে ২০,৪৪৪.৪৫ কোটি টাকা হয়েছে। কমেছে এসজিএসটি আদায়ও। অন্য দিকে, সংশোধিত হিসেব অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় করের অংশ হিসেবে পূর্বাভাসের তুলনায় ৩,১০০ কোটি টাকা বেশি পেয়েছে রাজ্য।

    সরকারি হিসেবে ১ শতাংশ অতিরিক্ত ডিএ দিতে মাসে বাড়তি ৬৪.২৫ কোটি টাকা খরচ হবে। সে ক্ষেত্রে এপ্রিল থেকে বাড়তি ৪% ডিএ দিতে রাজ্য কোষাগার থেকে মাসে অতিরিক্ত ২৫৭ কোটি টাকা খরচ হবে। অর্থাৎ, বছরে শুধু অতিরিক্ত ৪% ডিএ খাতেই সরকারকে বাড়তি ৩,০০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করতে হবে। তার সঙ্গে বিপুল রাজস্ব ঘাটতির চাপ তো রয়েইছে।

    এই পরিস্থিতিতে বাজার থেকে ঋণ নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ রাজ্যের সামনে নেই বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ। সংশোধিত হিসেবে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে রাজ্য বাজার থেকে মোট ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে। যা আগামী অর্থবছরে বেড়ে ৮১,৯৭২.৩৩ কোটি টাকা হবে বলে এ দিন পেশ করা বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের শেষে রাজ্যের মোট ঋণভার ৭,৭১,৬৭০.৪১ কোটি টাকাতে দাঁড়াবে। যদিও সরকারের দাবি, ২০১০–১১ সালে জিএসডিপি–র নিরিখে ঋণের হার ছিল ৪০.৬৫%, যা ২০২৫–২৬ সালে হ্রাস পেয়ে আনুমানিক ৩৭.৯৮% হবে।

    কী ভাবে বাড়তি অর্থের জোগান হবে?

    মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘আমরা আমাদের রাজস্ব সংগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছি। আমাদের ৯৪টি সামাজিক প্রকল্প রয়েছে। কোথাও রয়েছে? এমন দেখান। তবুও আমরা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জিএসডিপি রেট বৃদ্ধি করেছি, জিডিপি রেট বৃদ্ধি করেছি, শিল্প পরিকাঠামো, ,সামাজিক উন্নয়ন, কৃষি, সার্ভিস সেক্টরে উন্নয়ন হচ্ছে। ১ কোটি ৭৫ লক্ষ মানুষকে আমরা দারিদ্র সীমার উপরে নিয়ে এসেছি।’

    রাজ্যে শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ২ কোটি জীবিকা সৃষ্টি হওয়ার ফলে বেকারত্বের হার ৪০% হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছেন চন্দ্রিমা।

    রাজ্য বাজেটের প্রশংসা করেছে বণিকমহল। রাজ্য বাজেটকে বৃদ্ধি অভিমুখী বলে বর্ণনা করেছেন বণিকসভা এমসিসিআই-এর সভাপতি অমিত সারাওগি। ভারত চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি এনজি খৈতানের মতে, বর্তমান আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধান এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের লক্ষ্যে জনমুখী, দূরদর্শী এবং বাস্তববাদী বাজেট পেশ করা হয়েছে।

    প্যাটন গোষ্ঠীর এমডি সঞ্জয় বুধিয়া বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একসঙ্গে বহু সমস্যার সমাধান থেকে শুরু করে সার্বিক উন্নয়নের জন্য সফলতার সঙ্গে একাধিক কৌশল নিয়েছেন।’ বণিকসভা আইসিসি–র ডিরেক্টর জেনারেল রাজীব সিং জানিয়েছেন, বাজেটে পরিকাঠামো উন্নয়ন, জলবায়ু বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, সামাজিক ক্ষমতা তৈরি, চা শিল্পকে চাঙ্গা করা এবং বেতনভোগীদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির তরফে বিবেক জালান জানান, এমএসএমই ক্ষেত্রে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ১,২২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা তাদের আরও উদ্বুদ্ধ করবে।

  • Link to this news (এই সময়)