• পড়া পড়া খেলায় ফের স্কুলমুখী দলছুট কচিকাঁচার দল
    এই সময় | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • বিশ্বরূপ বিশ্বাস, ইসলামপুর

    ক্লাসে যদি হয় ‘পড়া পড়া খেলা’, তবে স্কুল মানে তো মজার বাড়ি! যেখানে নাচে–গানে–গল্পে কখন যে শক্ত শক্ত বিষয়গুলি হেসেখেলে মনে গেঁথে যায়, টেরও পায় না পড়ুয়ার দল। স্কুল না–থাকলে বাড়িতে একটুও মন টেকে না ওদের। শনিবার উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর শিবনগর কলোনি প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে দেখা গেল এমনই অবাক করা ছবি। স্কুলে এসে মুখ ভার খুদেদের। কিন্তু কেন? জানতে চাওয়া মাত্র ওরা বলে উঠল, ‘কাল রবিবার গো। স্কুল বন্ধ’!

    এই স্কুলে এলে দেখা যাবে, কোথাও গান গাইছে পড়ুয়ারা, কোথাও আবার প্রধান শিক্ষক নিজেই তালে তালে নাচছেন কচিকাঁচাদের সঙ্গে। গল্পচ্ছলে চলছে পড়ানোর কাজ। এই ক্লাস মোটেও গুরুগম্ভীর নয়। বরং হরেক কিসিমের আনন্দে ভরা।

    ইসলামপুর ব্লকের ছোট্ট একটি গ্রাম শিবনগর কলোনি। ১৯৬৫ সালে গ্রামে তৈরি হয়েছিল সরকারি এই প্রাইমারি স্কুলটি। ২০১৪ সালে এখানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ইসলামপুরেরই শ্রীকৃষ্ণপুর এলাকার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ হাওলাদার। তিনি লক্ষ্য করেন, গ্রামে প্রচুর ছোট ছেলেমেয়ে থাকলেও স্কুলে পড়ুয়া মাত্র ৪৮ জন। তা–ও সবাই স্কুলে আসে না।

    তিনি বলেন, ‘তখন শিক্ষকদের দেখলে পালিয়ে যেত স্টুডেন্টরা। মাথায় আসে, ওদের সঙ্গে যদি বন্ধুর মতো মিশি, তা হলে হয়তো কাজ দেবে। কথা বুঝতে পারি, খেলা–নাচ–গানের মাধ্যমে যদি পড়ানো যায়, তা হলে হয়তো গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুলমুখী হবে।’

    এর পরেই স্কুলে নতুন নিয়ম চালু করেন তিনি। কেমন নিয়ম? বাড়িতে গুরুজনকে প্রণাম করে স্কুলে আসতে হয় ছোটদের। প্রেয়ার লাইনে জাতীয় সঙ্গীতের পরে গাওয়া হয় ব্রতচারী ও স্বাস্থবিধান গান। এর পর ১০ মিনিট ধ্যান করে ওরা। তার পর বেশ কিছুক্ষণ চলে কুইজ়। তাতে কে আগে উত্তর দেবে, তা নিয়ে লড়াই জমে ওদের মধ্যে। সে হুল্লোড়ের পরেই সংবাদপাঠের পালা। গ্রামে সারা দিন কী হলো, তা নিয়ে খবর পড়া হয়।

    এর পর যে যার ক্লাসরুমে চলে যায়। রোল কলের সময়ে কিন্তু ইয়েস স্যর বলা মানা ক্লাসে। কখনও ওরা বলে মণীষীদের নাম, কোনও দিন আবার এক এক করে দেশের রাজ্যগুলির নাম উচ্চারণ করে ওরা। সেই ফাঁকে কখন যে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে সে সব, নিজেরাই জানে না ওরা। রোলকল শেষে শুরু হয় ক্লাস। গল্পে গল্পে বিষয়গুলি পড়ানো হয় সেখানে।

    এর পর মিড–ডে মিল খেয়ে শুরু হয় অন্য তালিম। নাচ–গান–খেলায় পড়ান শিক্ষক। তার পর বাজে ছুটির ঘণ্টা। বাড়ির পথে হাঁটা দেয় খুদের দল, পরের দিনের ক্লাসে কোন নতুন খেলা হবে, সে গল্প করতে করতে। রবিবার তাই ওরা মোটেও বলে না, ‘আজ আমাদের ছুটি রে ভাই’। স্কুলের ছাত্র গোপাল রায় বলে, ‘যদি রবিবারও স্কুল খোলা থাকে, তবুও যাব। বাড়িতে থাকলে স্কুলের স্যরদের মিস করি।’

    সবটাই অবশ্য ছেলেখেলা নয়। স্কুলে রয়েছে মন্ত্রিসভা। সেখানে ওরা দায়িত্ব নিতে শিখছে। সবাই নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন। কাজে ভুলচুক যাতে না–হয়, তা নিয়ে সতর্ক। গত ১০ বছরে নয়া এই নিয়মে কাজ হয়েছে ম্যাজিকের মতো। এখন স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১২০ জন।

    প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘সরকার স্কুল করে দিয়েছে, সেখানে পড়ুয়ারা আসবে না, বিষয়টা ভালো লাগেনি। মূলত পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করতে আমার এই উদ্যোগ। আমার ছাত্রছাত্রীরা মানুষের মতো মানুষ হবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শুধু আমি নই, আমার সহ-শিক্ষকরাও আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন।’

    স্কুলের শিক্ষক রাজু দাস বলেন, ‘ইসলামপুরের অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের থেকে আমাদের স্কুল ভিন্ন ভাবে চলার চেষ্টা করে। তার একমাত্র কারণ প্রধান শিক্ষক। পড়ুয়াদের সঙ্গে যে শিক্ষকদের এমন সম্পর্কও হয়, ভাবিনি কোনও দিন। আমরা প্রতি মুহূর্তে ওঁকে দেখে অনেক কিছু শিখি।’

    স্কুলের ছাত্র প্রমাণ ও প্রবেশের বাবা প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, ‘আমার দুই ছেলে আগে ইসলামপুরের একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। ওখান থেকে বের করে এনে আমি ওদের গ্রামের এই প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করি। রাজ্যের সব স্কুল যদি এই স্কুলের মতো হতো, তা হলে হয়তো ব্যাঙের ছাতার মতো এত বেসরকারি স্কুল গড়ে উঠত না।’

  • Link to this news (এই সময়)