পিনাকী চক্রবর্তী, আলিপুরদুয়ার
এক সময়ে তাঁর হাতে থাকত কালাশনিকভ। সেই অস্ত্রের ঝলকানিতে নিকেশ হয়েছে একের পর এক পাকিস্তানি জঙ্গি। অবসর জীবনে এসে সেই মানুষটিই হয়ে উঠেছেন একজন কারুশিল্পী। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে বন্দুক চালনার তালিম নিয়েছিলেন তিনি। প্রাক্তন এই সেনাকর্মীর নাম শান্তিরাম রাভা।
আলিপুরদুয়ার কুমারগ্রাম ব্লকের ভলকা ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্ব শালবাড়ির বাসিন্দা। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর পরেই সংসারের হাল ধরতে যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। যখন জম্মুকাশ্মীরে উগ্রপন্থা চরমে, সেই সময়ে কাজ করেছেন ভারত–পাকিস্তান সীমান্তে।
কার্গিল যুদ্ধে সরাসরি যোগ না দিলেও ছিলেন যুদ্ধের ইউনিটে। পরের বছর, ২০০০ সালেই ছিল তাঁর অবসর। তাই শান্তিরামকে রিজার্ভ ব্যাটেলিয়নে রাখা হয়েছিল। একটা সময়ে দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় যাঁর আঙুল থাকত অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগারে, তাঁর হাতে এখন হাতুড়ি আর বাটালি।
কী ভাবে চলে এলেন শিল্পের দুনিয়ায়। শান্তিরাম বলেন, ‘ভাগ্নির বিয়ের আসবাব বানানোর পর এক টুকরো কাঠ বাড়িতে পড়েছিল। সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবছিলাম, কী করা যা। সেই সময়ে আমাদের বাড়ির গোরু মাঠ থেকে চড়ে বাড়ি ফিরছিল। তখনই হঠাৎ মাথায় আসে, ওই কাঠের টুকরো দিয়ে গোরু তৈরি করা যায় কি না। সেটাই শুরু বলতে পারেন।’
কয়েকদিনের চেষ্টার পর দেখা যায়, গোরু নয়, কাঠের টুকরোটি একটি গন্ডারের রূপ নিয়েছে। প্রথমে গ্রামের বন্ধু ও পরিচিতদের সেই গন্ডার দেখানোর পর প্রায় কেউই বিশ্বাস করতে চাননি, সেটি তাঁর তৈরি। সেই থেকে শান্তিরামের শিল্পী হয়ে ওঠার পর্ব শুরু। হাতুড়ি–বাটালিকে সঙ্গী করে নেন প্রাক্তন সেনাকর্মী। গ্রামের এ দিক–সে দিক ঘুরে বেরিয়ে বিভিন্ন আকারের কাঠের টুকরো জোগাড় করে পুরোদমে নেমে পড়েন কারুশিল্পে।
একে একে তাঁর হাতে হাতি, হরিণ, ঈগল রূপ পেল। মূর্ত হলো শিব, লোকনাথের মূর্তি। এই কাজের মধ্যে দিয়ে নতুন করে পরিচিতি বাড়তে থাকে শান্তিরামের। বিভিন্ন জায়গা তাঁর প্রদর্শনীর বরাত আসতে শুরু করে। জেলায় কোনও নেতা–মন্ত্রীর আগমন ঘটলেই তাঁর কাছে কাঠের বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ আসে। শিল্পীর হাতের তৈরি গন্ডার, হাতি–সহ দেবদেবীর মূর্তি মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও অনেক বিশিষ্ট মানুষের হাতে পৌঁছে গিয়েছে একাধিকবার।
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছে গিয়েছে প্রাক্তন সেনাকর্মীর হাতে গড়া শিল্পকর্ম। জীবনের এই দ্বিতীয় ইনিংস নিয়ে যথেষ্ট তৃপ্ত শান্তিরাম রাভা। কাজের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন অপার শান্তি ও অনাবিল আনন্দ। বলেন, ‘আমাদের মতো গরিব পরিবারে শিল্প শেখার পাঠ নেওয়া তখন বিলাসিতা ছিল। বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় থাকায় মাধ্যমিক পাশ করার পরেই ছুটতে হয়েছিল শিলিগুড়ির সেনাবাহিনীর লাইনে। কৃতকার্য হয়ে যাওয়ায় আমি আর বাড়ি ফিরতে পারিনি। ঠিক এক বছর পরে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরার পর মায়ের কান্না এখন মনে পড়ে।’ এখন সেই অগ্নিযুগ অতীত। পেলব শিল্পের আনন্দেই বেঁচে আছেন শান্তিরাম।