বইমেলা শেষ হয়েছে। বইমেলা রয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র অজস্র নামী-অনামী বই পড়িয়ের ঘরে তোলা বইয়ের নতুন ফসল হিসাবে নয়, এ বইমেলার কিছু খণ্ডও থেকে গিয়েছে। বইমেলার জার্মান প্যাভিলিয়নের মণ্ডপটিই এ বার নতুন করে ব্যবহারে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেছে কলকাতার গ্যেটে ইনস্টিটিউট। সেখানকার ডিরেক্টর অ্যাস্ট্রিড ওয়েগের কথায়, “প্যাভিলিয়নের কাঠামোটা খোলার পরে তা টুকরো টুকরো বুক শেলফ বা বইয়ের তাক হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব। কিছুটা কলকাতার ম্যাক্স মুলার ভবনে (এখন পার্ক ম্যানসন বিল্ডিংয়ে) থাকবে। কিছুটা কোনও স্কুল বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে দেওয়া হবে। পরিবেশ সচেতনতার স্বার্থে মণ্ডপটি তৈরিই হয়েছে রিসাইকল করা বা পুনর্ব্যবহারের সম্ভাবনা মাথায় রেখে।”
ভারতীয় দর্শন তাৎক্ষণিকতার মধ্যেও অনন্তের আস্বাদ খোঁজে। জার্মান প্যাভিলিয়নের মাধ্যমে বইমেলার স্মৃতির বিস্তার ঘটিয়ে স্থাপত্যের ভাষায় সেই দর্শনকেই মূর্ত করে তোলেন মণ্ডপটির রূপকার অনুপমা কুণ্ডু। বইমেলার জার্মান প্যাভিলিয়নের ধাঁচ কেমন হবে, তা নিয়ে জার্মান কর্তৃপক্ষ স্থপতিদের একটি প্রতিযোগিতার ডাক দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র বৈচিত্র এবং স্থায়িত্ব, এই দুটো ভাবনা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বার্লিনবাসী, বিশিষ্ট স্থপতি অনুপমার কাজটা তাতেই সোজা হয়ে যায়। জার্মানি থেকে ফোনে তিনি বলছিলেন, “বৈচিত্র, সমন্বয়, স্থায়িত্বের ধারণাগুলো তো আমাদের ভারতীয়দের মজ্জাগত। সেই সঙ্গে জার্মানসুলভ ইঞ্জিনিয়ারিং কৃৎকৌশলও আমরা কিছুটা মেলাতে পেরেছি।”
চূড়াকৃতি ওই জার্মান প্যাভিলিয়নের ভিতরে ঢুকলেও স্বচ্ছ ধাতব পাতের ও-পারে বাইরের আকাশ দেখা যেত। যেন এক ধরনের দেওয়ালহীন পরিসর। কাঠ আর স্বচ্ছ পাতের বইয়ের তাকগুলি ধরে থাকে হালকা স্টিলের কাঠামো। দেখলে মনে হয়, আলোয় ঘেরা কিছু বইয়ের তাক। বইমেলা ভাঙার পরে বুক শেলফগুলি সহজেই খুলে নেওয়া গিয়েছে।অনুপমা বলছিলেন, “বই মানেই নানা রঙা ভাবনা। অজস্র বইয়ের তাকের মিশেলে সমন্বয়ের সুরই তুলে ধরেছি।” দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের প্রবাসী বাঙালিনি অনুপমা। এত দিন বাঙালি বন্ধুদের কাছে শুধু বইমেলার গল্প শুনেছিলেন। তবে কাসুন্দি, সর্ষের তেলের ঝাঁঝের ভক্ত এই বঙ্গকন্যা নিজেকে বাংলার বাইরের কেউ ভাবেনই না। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। মায়ের ছোটবেলা কলকাতাতেই কেটেছে। মুম্বইয়ে বড় হওয়া অনুপমা অরবিন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত। পুদুচেরির সঙ্গেও তাঁর গভীর যোগ। বইমেলার এই প্রকল্পটিতে বাজেটের বাহুল্যের থেকেও সৃজনশীলতায় জোর দেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুনাথ, পুণের স্থপতি যশোদা জোশী, শ্রেষ্ঠা গোপালকৃষ্ণনেরা একযোগে অনুপমার সঙ্গে এই কাজ করেন। সুযোগ পেলে আবারও বাংলায় নিজের শিকড়ের কাছে ফিরতে চান তিনি।
বইমেলার মাঠে সার্বিক ভাবে জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতিকে মেলে ধরার সুযোগ বেড়েছে বলে অভিমত গ্যেটে ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষের। অ্যাস্ট্রিড বলছিলেন, “গ্রন্থ প্রকাশক, বইশিল্পী (ডিজ়াইনার), অনুবাদক এবং বিভিন্ন নেপথ্যকর্মী আমাদের প্যাভিলিয়নে বসেছিলেন। কলকাতার কিছু গুণী বইশিল্পী ও প্রকাশকের সঙ্গে জার্মানিতে নতুন কাজের দরজা খুলবে বলেও আশা করছি।” বইমেলাকে ঘিরে জার্মানি ও বাংলার সম্পর্কে একটি নতুন অধ্যায়েরও সূচনা হল।