• বাড়ি থেকে একাই ১০ কিমি জঙ্গলের পথ উজিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে সঞ্জয়
    বর্তমান | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • রাজদীপ গোস্বামী, ভাদুলিয়া: ঘন জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম। চারপাশে শুঁড় দোলাতে থাকে দাঁতালের দল। মর্জি বিগড়ে গেলেই হানা—সেই আশঙ্কায় অষ্টপ্রহর ‘রাম নাম’ জপে গ্রামের ছেলে-ছোকরা থেকে বুড়ো। এখনও গ্রাম ঘিরে রয়েছে প্রায় একশোটি হাতির দল! ক’দিন আগেই গ্রামের একটি বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে দাঁতালরা। 


    এখন মাধ্যমিক চলছে। হাতির হামলা থেকে পরীক্ষার্থীদের সুরক্ষা দিতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে বনদপ্তর। পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিতেও বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। ভাদুলিয়া গ্রামের পরীক্ষার্থী সঞ্জয় অবশ্য এসবের ধার ধারে না। বাইকে পৌঁছে যায় পরীক্ষাকেন্দ্রে। বাড়ি থেকে পরীক্ষকেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ১০ কিমি। 


    সঞ্জয়ের পুরো নাম সঞ্জয় হাঁসদা। নিতান্ত গরিব আদিবাসী পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। জঙ্গল-জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে অসীম সাহস লাগে। শৈশবেই সেটা বুঝে গিয়েছে সঞ্জয়। তার উপর হত দরিদ্র পরিবার। অভাবের সঙ্গে লড়াই ছোট থেকেই। হাতির ভয়ে গ্রামের অন্যান্য পড়ুয়ারা হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। কেউ পড়ছে সেভেনে। কেউ বা ক্লাস  নাইনে। বাড়ি থেকে দীর্ঘ জঙ্গল পথ ধরে স্কুলে যাওয়ার ঝুঁকি নেয়নি কেউই। সঞ্জয় একাই ব্যতিক্রম। সে বাড়িতে থেকেই দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষাও দিচ্ছে বাড়ি থেকে যাতায়াত করে। আসলে, ক্লাস ফাইভ থেকে দশম—মাঠে কৃষিকাজ করেই পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছে। কিছু পয়সা উদ্বৃত্ত হলে বাবার হাতে তুলে দিয়েছে। সেই সঞ্জয়কে হস্টেলে থাকতে হলে মাধ্যমিক পর্যন্ত যাওয়াই আর হতো না। তাই, হাতির ভয়কে জয় করেই বাড়িতে থেকে যাওয়া সঞ্জয়ের। 


    মেদিনীপুর সদর ব্লকের মোহনানন্দ হাইস্কুলে সিট পড়েছে ভাদুলিয়া গ্রামের একমাত্র এই পরীক্ষার্থীর। মেধাবী ছাত্র বলেই গ্রামে পরিচিত। বাংলা-ইংরেজিতে ভালোই পরীক্ষা হয়েছে সঞ্জয়ের। এরপর অঙ্ক। বৃহস্পতিবার সকালে মাঠে গিয়েছিল কাজ করতে। বিকেলে বাড়ির উঠোনে বসে পার্টিগণিতের জটিল সমস্যার সমাধান করছিল সে। খাতা থেকে চোখ সরিয়ে বলছিল, ‘আমাদের গ্রামে হাতির ভয় সর্বক্ষণ। মাঝে মধ্যেই ওরা এসে ভাঙচুর চালায়। তাই, গ্রামের প্রায় ৯৯ শতাংশ পড়ুয়া হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। কিন্তু আমার হস্টেলে যাওয়ার আর্থিক অবস্থা নেই। মাঠে কাজ করে পড়তে হয়। হাতির দৌরাত্ম্যে পড়াশোনায় ক্ষতি হয় ঠিকই। তা বলে বাড়ি ছেড়ে পালানোর উপায় নেই আমার। তা সত্ত্বেও আমার পরীক্ষা ভালোই হচ্ছে। আশা করছি ভালো রেজাল্ট হবে।’ আত্মবিশ্বাসী সঞ্জয়। সঞ্জয়ের বাবা বুদ্ধেশ্বর হাঁসদা ও স্ত্রী প্রতিমা হাঁসদা চাষের কাজ করেন। সংসারে অভাব মেটাতে সঞ্জয়কেও সেই কাজ করাতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা। সঞ্জয়ের কথায়, ‘ভয়কে সঙ্গী করেই স্থানীয় নয়াগ্রাম স্কুলে যেতাম। সবুজসাথীর সাইকেল ভরসা। বিকেলের পর আর টিউশনিতে যেতে পারতাম না। পাছে হাতির হামলার মুখে পড়ে যাই! তাই আমার কোনও গৃহ শিক্ষক কেউ নেই।’ নাতির পাশে বসে ঠাকুমা মালতি হাঁসদা বলছিলেন, ‘নাতি খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। ওর ফলাফল ভালোই হবে।’ মেদিনীপুর ডিভিশনে ৩৫ টি হাতি রয়েছে। রূপনারায়ণ ডিভিশনে হাতির সংখ্যা ৭০ ছুঁইছুঁই। হাতির আক্রমণে আলু সহ বিভিন্ন সব্জির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। হাতি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষ ড্রাইভ চালাচ্ছে বনদপ্তর। ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যেতেও সহযোগিতা করা হচ্ছে। রূপনারায়ণ বনবিভাগের ডিএফও শিবানন্দ রাম বলেন, ‘গোটা পরিস্থিতির উপর নজর রাখা হচ্ছে। কেউ আতঙ্কিত হবেন না।’
  • Link to this news (বর্তমান)