দক্ষিণ দমদমের পদ্মবনে প্রেমের অচেনা গদ্য লিখছে নতুন প্রজন্ম
বর্তমান | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, বরানগর: স্থলে রাধাচূড়া, শিমুল, বকুল মাথা দোলাচ্ছে। জলে তিরতির করে কাঁপছে পদ্ম। বেঞ্চে দীর্ঘ সময় প্রতিক্ষা করতে করতে এসবই দেখছিলেন অষ্টাদশী। তখন গোধূলি। সে আলোয় আর লজ্জায় রাঙা হয়ে দৌড়ে ঢুকলেন প্রেমিক। আজ দু’জনের দেখা করার দিন। তবে এতটাই দেরি হয়ে গিয়েছে যে, আলিঙ্গনের প্রশ্নই উঠছে না। বেঞ্চের কাছে আসে জিভ কাটলেন তরুণ। কানও ধরলেন। ‘খুব জ্যাম রাস্তায়। সরি’-তবে ছদ্ম হলেও রাগ দেখাতে ছাড়লেন না তরুণী। শেষে লাল গোলাপ মাথার চুলে গুঁজে দেওয়ার পর খানিক রক্ষে। তবে শাস্তি কপালে ছিলই। সদ্য প্রেমিকার দাবি মেটাতে নিরাপত্তা কর্মীর চোখ এড়িয়ে পদ্ম তুলতে হল জল থেকে। তারপর একজীবন একসঙ্গে থাকার প্রতিজ্ঞার পর আলিঙ্গনবদ্ধ হল দু’টি মন-দেহ। ভিআইপি রোডে দক্ষিণ দমদম পুর এলাকায় হয়েছে একটি পদ্মবন। সেখানে রোজ (গোলাপ) হাগ (আলিঙ্গন) বা ভ্যালেন্টাইন (প্রেম) ডে’তে এরকম কাহিনি রচনা চলছে সকাল-সন্ধ্যা। বিশেষ কোনও দিবস ছাড়াও সে পদ্মবনে প্রেমের একাধিক গদ্য লেখা চলছে নতুনভাবে, নিত্য ।
ভিআইপি রোডের ধারের নয়ানজুলি। তার চারপাশে ছিল জঞ্জালের স্তূপ। জল ভর্তি ছিল কচুরিপানায়। হাঁটাচলার জায়গা ছিল না। দু’দণ্ড সময় কাটানোরও উপায় ছিল না। চারদিক ঘিরে গাড়ি রাখা হতো। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর পরিকল্পনায় ও মন্ত্রী সুজিত বসুর উদ্যোগে বদলে গিয়েছে সে নয়ানজুলির চেহারা। এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে বাঙুর থেকে দমদম পার্ক পর্যন্ত এই লম্বা জলাভূমির বিস্তার। এখন সেটি ঘিরেই হয়েছে সাজানো গোছানো উদ্যান ‘ঝিল্লিকা’। পূর্তদপ্তর এর রক্ষণাবেক্ষণ করে।
এই পার্কটিই এখন যুগলদের নয়া গন্তব্য। এবং এলাকাবাসীর কাছে মুক্ত বাতাসের নয়া ঠিকানাও। সরস্বতী পুজোর দিন পার্ক ভরে গিয়েছিল হলুদ পাঞ্জাবি-শাড়িতে। নয়ানজুলির দু’পার পাথর দিয়ে বাঁধানো। সারি দিয়ে রয়েছে রাধাচূড়া, গোলাপি বসন্তরানি, হলুদ বসন্তরানি, পলাশ, বকুল, শিমুল, বোতলব্রাশ (উইপিং বটলব্রাশ। বৈজ্ঞানিক নাম, ক্যালিসটেমন ভিমিনালিস)। তার মাঝে উঁকি দিচ্ছে সবেদা, আম, নারকেল, গোলাপজাম, কালোজাম, কাঠবাদাম, বাক্সবাদামের গাছ। এছাড়াও আছে নিম, অর্জুন, কদম, অশ্বত্থ, রক্তচন্দন ও রুদ্রাক্ষ। আর দীর্ঘ নয়ানজুলি ভর্তি পদ্মফুলে। সে শতদলবনে ফোয়ারা থেকে ব্রাশের মতো ছড়িয়ে পড়া জল মায়া তৈরি করে। আর দেবী দুর্গার আসার প্রস্তুতি, আরাধনা ও বিসর্জনের পটচিত্রও চোখ টানে সবার। প্রাতর্ভ্রমণ থেকে বিকেলের পায়চারি, এলাকার মানুষের কাছে এখন অন্যতম গন্তব্য ঝিল্লিকা উদ্যান। যুগলরা এখানে এসে ভালোবাসার স্বপ্ন বুনছেন। নেট নাগরিকরা রিল তৈরি করছেন। সবমিলিয়ে প্রবল জনপ্রিয় ঝিল্লিকা। তবে একটি কাঁটাও খচখচ করে ফুটছে।
এই পার্ক ভোর পাঁচটায় খোলে। আর সকাল ১০টা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ফলে দুপুরের বিস্তীর্ণ সময় কেউ পদ্মবনে ঢুকতে পারেন না। পার্কে আসা অনেকেই দুপুরে পার্ক খোলা রাখার দাবি তুলেছেন। সন্ধ্যায় পায়চারি শেষে বেঞ্চে বসেছিলেন বাঙুরের এক বৃদ্ধ দম্পতি। কমবয়সিদের প্রেম দেখে তাঁদের মুখে স্মিত হাসি। মজা করে বৃদ্ধ বললেন, ‘পদ্ম পাতায় জল করে টলমল। তবে এই টলমল, অস্থির সময়ও প্রেম আর প্রতিজ্ঞা কেমন মিশছে দেখো। কি ভালোই না লাগছে।’