• ইসলামপুরের রূপনগর প্রেমগলি? এক্সকিউজ় মি প্লিজ
    এই সময় | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • বিশ্বরূপ বিশ্বাস, ইসলামপুর

    রূপনগর প্রেমগলি খোলিনাম্বার চারশো বিশ। এক্সকিউজ় মি প্লিজ—

    অমর আকবর অ্যান্টনি সিনেমার নায়ক অ্যান্টনি গনজ়ালভেস এ ভাবেই প্রোপোজ়–সং গেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নসুন্দরী জেনির উদ্দেশে। তবে সেই দিনটি ভ্যালেন্টাইন্স ডে ছিল কি না তা স্পষ্ট নয়, আর দৃশ্যটির প্রেক্ষাপটে প্রেমগলিও ছিল না। তবুও ওই গানের অদ্ভুত লিরিক্সে উঠে আসে প্রেমগলি, যা প্রাক ইন্টারনেট যুগে যুগলদের কাছে ছিল ওয়ান পয়েন্ট টার্গেট।

    আর ছিল চিরকুট। হোমিয়োপ্যাথ পুরিয়ার মতো। ভাঁজ খুললেই হৃদয়ের ধুকপুকুনির সঙ্গে পরতে পরতে মিশে থাকত প্রেমের আবেশ। প্রেমগলি আর চিরকুটের রসায়নে জমে উঠত আমজনতার প্রেমের আখ্যান। ফাইভ জি নেটওয়ার্কের যুগে যা হারিয়ে গেল চিরতরে।

    প্রতি বছর ঋতুচক্র মেনে বসন্ত এলেও যে প্রেমগলি আর হাতছানি দেয় না। ল্যান্ডফোন তখন অনেকের কাছেই স্বপ্ন। ভরসা কাগজের চিরকুট। সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্য, অনেকটা সঙ্কেতের মতো। ‘আজ বিকেল পাঁচটায় শিবডাঙিপাড়ার গলির মোড়।’ ব্যস! অনেকটা টেলিগ্রাম টাইপ। তাতেই চিরকুট প্রাপক বুঝে যেত তার পরবর্তী করণীয়।

    উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর পুর এলাকার কয়েকটি গলির নামই হয়ে গিয়েছিল প্রেমগলি। সিসিটিভি ক্যামেরার মতো পাড়ার কাকিমাদের নজরদারি এড়িয়ে, নীতিপুলিশের ঝামেলা সামলিয়ে প্রেমিক–প্রেমিকারা বেছে নিত শিবডাঙিপাড়া, এসডিও বাংলোর পাশের গলি।

    সেই সব গলিতেই জন্ম নিয়েছে ছোট ছোট মানুষের বড় বড় সুখ–স্বপ্ন। ইসলামপুরের বাসিন্দা কাঞ্চন দাস ও দেবশ্রী সাহা ওই সব গলিতে চুটিয়ে প্রেম করেছেন। দেবশ্রীর কথায়, ‘ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে কাঞ্চনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। ২০০৭–এ কলেজে পড়াকালীন আমাদের প্রেম শুরু। তখন সেলফোন ছিল না। বান্ধবীর হাত দিয়ে কাঞ্চনকে চিঠি পাঠাতাম। টিউশনের পরে কোথায় দেখা করব, চিঠিতেই লেখা থাকত। এ ভাবেই দেখা হতো আমাদের।’

    খোলাখুলি ঘুরে বেড়াতে পারতেন না জানিয়ে দেবশ্রী বলছেন, ‘দেখা করার একটাই রাস্তা ছিল, শিবডাঙিপাড়ার সেই গলি। সামান্য কয়েক মিনিটের দেখা। তার পর আবার যে যার বাড়ি। ২০১৩ তে আমাদের বিয়ে হয়। এখনও প্রেমগলির সামনে দিয়ে গেলে পুরোনো স্মৃতি ঘিরে ধরে মনের মধ্যে।’

    আবার এই সব গলিতেই ছড়িয়ে রয়েছে কত ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা। ইসলামপুর শহরেরই এক জন জানাচ্ছেন, স্কুলে পড়ার সময়ে এসডিও বাংলোর সামনের গলিতে হাঁটু গেড়ে প্রোপোজ় করেছিলেন তাঁর প্রেয়সীকে। উল্টো দিক থেকে গ্রিন সিগন্যাল এসেছিল বলেই সেই সাহস তিনি পেয়েছিলেন। বলছেন, ‘এই গলি ছিল আমাদের দেখা করার একমাত্র ভরসা। এ ভাবেই ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখলাম দীর্ঘ পাঁচ বছর। আমরা বড় হলাম, সঙ্গে আমাদের প্রেমও। তবুও একটা সময়ে ভালোবাসার মানুষকে পাইনি। পরিবারের চাপে তাঁর বিয়ে হল অন্য কোথাও। সে আজ অন্য কারও গল্পের নায়িকা। আমারও সংসার হয়েছে।’

    শিবডাঙিপাড়ার বাসিন্দা নৃত্যশিল্পী আইভি বিশ্বাস জানাচ্ছেন, সে সময়ের প্রেম, আর এ সময়ের প্রেমের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আইভি বলছেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে একটি গলি ছিল। এখনও আছে। তখন দেখতাম বাইরের ছেলেমেয়েরা এই গলিতে এসে দেখা করত। চিঠি দেওয়া–নেওয়াও চলত। ওই সময়ে আশিকি সিনেমাটা রিলিজ করেছিল বলে গলিটার নামই হয়ে গেল আশিকি গলি। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে গলি হারিয়ে গিয়েছে। আজ আর গলিতে কোনও প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করে না। এক পলকের একটু দেখা— আর হয় না।’

    এখন আর কোনও অ্যান্টনি তার প্রিয়তমার উদ্দেশে রূপনগর প্রেমগলির গান শোনায় না। অ্যান্ড্রয়েডের ভিডিয়ো কল ইতিহাসের পাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে প্রেমগলি আর চিরকুটকে।

  • Link to this news (এই সময়)