ঘন কুয়াশায় সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মোটরবাইকে সওয়ার যুবকের কাছে ঘন ঘন ফোন এসে চলেছে, অর্ডার দেওয়া খাবার কত ক্ষণে পাওয়া যাবে জানার জন্য। দ্রুত খাবার পৌঁছনোর তাড়ায় অ্যাপ সংস্থার ওই কর্মী, বছর আটত্রিশের অবিনাশ মাঝি ঘন কুয়াশায় বুঝতেই পারেননি যে, উল্টো দিক থেকে একটি লরি ছুটে আসছে। লরির চাকা চলে যায় তাঁর পায়ের উপর দিয়ে। সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে চারটি হাসপাতাল ঘুরে শেষে এসএসকেএমে জায়গা পান অবিনাশ। অভিযোগ, সেখানেও পাঁচ ঘণ্টা ট্রলিতেই ফেলে রাখা হয় তাঁকে। শেষে একটি পা বাদ যায় তাঁর।
মা-বোনের সংসারে একমাত্র রোজগেরে অবিনাশ বুঝে উঠতে পারছেন না, আর কাজ করবেন কী করে? এ দিকে, অ্যাপ সংস্থার কাছে সাহায্যের জন্য বার বার ঘুরছেন তাঁর মা। মঙ্গলবার অবিনাশের মা বললেন, ‘‘প্রথমে বলা হয়েছিল, এই কাজে মৃত্যু হলে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। সাহায্য পাওয়ার জন্য ছেলেকে কি তা হলে মরতে হত?’’
কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, অ্যাপ সংস্থায় কর্মরতদের এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেই বছরের পর বছর কাটাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের দাবি, ‘গিগ ওয়ার্কার’ হিসাবে পরিচিত এমন ক্ষেত্রের কর্মীদের নিয়ে নানা স্তরে আলোচনা চললেও তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থা কী হবে, তা নিয়ে প্রশাসনিক স্তর থেকে কোনও পদক্ষেপই দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই পেশ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য বাজেট। চলতি বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে গিগ কর্মীদের প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার সঙ্গে যুক্ত করে পাঁচ লক্ষ টাকা বার্ষিক বিমার আওতায় আনার কথা বলা হলেও বিশেষ আশা দেখছেন না এই ক্ষেত্রের কর্মীরাই। ‘কলকাতা বিধাননগর ডেলিভারি রাইডার্স ইউনিয়ন’-এর সদস্য প্রিয়স্মিতার দাবি, ‘‘প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনায় যে কোনও ভারতীয় নাগরিক বিমার আওতায় পড়েন। এক জন গিগ ওয়ার্কারের জন্য তা হলে আলাদা করে আর কী করা হল? বাজেট যায়-আসে, বিপদ মাথায় ছোটার কাজে বদল হয় না।’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘রাজ্য বাজেটে তো এ নিয়ে কোনও পরিকল্পনাই চোখে পড়ল না। ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে এই ক্ষেত্রে কর্মীর সংখ্যা ২৩ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এটা গুরুত্ব না দেওয়ার মতো বিষয় কি?’’
একটি অনলাইন খাবার সরবরাহকারী সংস্থার কর্মী রতন সরকার বলেন, ‘‘দ্রুত খাবার বা সামগ্রী পৌঁছে দিলেই উপরি আয়ের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এতে বিপদ বাড়ছে। কেউ যদি ভাবেন, উপরি আয় বা ইনসেন্টিভ দরকার নেই, তা হলেও তিনি কাজ করতে পারবেন না। দ্রুত খাবার পৌঁছয়নি বলে হয়তো তাঁর আইডি ব্লক করে দেওয়া হবে।’’ আর একটি সংস্থার কর্মী সুমন হাজরার দাবি, ‘‘এমন সময়ের মধ্যে কাজ সারার টার্গেট দেওয়া হচ্ছে, যা অসম্ভব। কেন সময়ে অর্ডার পৌঁছয়নি, তা নিয়ে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। কী পরিস্থিতিতে কেউ বাইক চালিয়ে আসছেন, তা অনেকেই ভাবতে চাইছেন না।’’
‘কলকাতা বাইক-ট্যাক্সি অপারেটর্স ইউনিয়ন’-এর তরফে শান্তি ঘোষ বললেন, ‘‘এই কর্মীদের জন্য আলাদা করে আইন পাশ করা প্রয়োজন। সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে না আনলে কোনও বাজেটই এমন কোটি কোটি কর্মীর জীবনে পরিবর্তন আনতে পারবে না।’’