পাতিপুকুর থেকে হাসনাবাদ, আজও স্মৃতিপথে ছুটছে ট্রেন
বর্তমান | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
বিশ্বজিৎ মাইতি, বরানগর: বাগুইআটি-রাজারহাটের বাসিন্দারা তখন নিয়মিত শুনছেন কু-ঝিকঝিক। ধোঁয়া উগরে দৌড়চ্ছে ‘মার্টিনের রেল’। গতি কম। দৌড়ে যে কেউ ধরে ফেলতে পারে। আকারে ছোট। যেন খেলনাগাড়ি। টেনিদা বললে, ‘বাগুইআটি ছাড়িয়ে আরও চারটে ইস্টিশান। তার মানে প্রায় এক ঘণ্টার মামলা। লেডিকেনির হাঁড়িটা বের কর, ক্যাবলা।’
পাতিপুকুর, নন্দীপুর, বাগুইআটি, রাজারহাট, খড়িবাড়ি হয়ে সে ট্রেন যেত বসিরহাট। ১১৫ বছর আগে ১৯১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাতিপুকুর-বেলিয়াঘাটা লাইনে প্রথম চলাচল শুরু। এই রবিবার অর্থাৎ গতকাল চলে গেল তার জন্মদিন। তৎকালীন সময় ট্রেনটির প্রয়োজনীয়তা ছিল অসীম। তবে বন্ধও হয়ে যায় প্রায় ৭০ বছর আগে। ট্রেন লাইন, স্টেশন, রেল কোয়ার্টার সবই নিশ্চিহ্ন। কিন্তু প্রবীণ কিছু মানুষের স্মৃতিতে ও ইতিহাসের পাতায় দস্তুরমতো বেঁচে মার্টিন রেলের ‘বারাসত-বসিরহাট লাইট রেলওয়ে’। আর কিছু স্মৃতি বেঁচে বাগুইআটিতে, খড়িবাড়িতে, রাজারহাটে। বাগুইআটির বাগুই পরিবারের থেকে মার্টিন কোম্পানি কিনেছিল ১৫ একর জায়গা। বানিয়েছিল স্টেশন, স্টাফ কোয়ার্টার, রেল ইঞ্জিনে জল ভরার জন্য পুকুর। জায়গাটির নাম এখনও রেলপুকুরই রয়েছে। রাজারহাটে স্টেশনের জায়গায় এখন পূর্তদপ্তরের অফিস। খড়িবাড়িতে রয়ে গিয়েছে টিকিট কাউন্টারের ঘরটি । এখন একটি বাস রুটের স্টার্টার সে ঘরে বসেন।
রবিউলবাবুর বয়স পঁচাশি বছর। খড়িবাড়ি থাকতে এসেছিলেন ১৯৪২ সালে। বললেন, ‘বাবার সঙ্গে সব্জি নিয়ে রেলে উঠে বেলগাছিয়া যেতাম। এই ট্রেন না থাকলে না খেতে পেয়ে মরে যেতাম আমরা।’ ইতিহাসের গবেষক ও রাজারহাট-নিউটাউন, দমদমের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইয়ের লেখক মৌমিতা সাহা ও শ্যামল ঘোষ বলেন, ‘প্রান্তিক বসিরহাট মহকুমা ও খুলনা থেকে সরাসরি মাছ ও সব্জি আসত কলকাতায়।’ জানালেন, প্রতিদিন প্রায় ৫০০ মন মাছ, আড়াইশো মন দুধ-ছানা, ও সব্জি আসত। গ্রামীণ এলাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল এই ট্রেনের কারণেই। কলকাতাও পেত সতেজ খাবার। তৈরি হয়েছিল সরবরাহের বড় চেন।
মার্টিনের শ্যামবাজার স্টেশনের জায়গায় বর্তমানে রয়েছে বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপো। পাতিপুকুর স্টেশন ছিল যশোর রোড লাগোয়া স্বামীজি সঙ্ঘের গ্রন্থাগার লাগোয়া। শ্যামনগর রোডের উপর ছিল নন্দীপুর স্টেশন। এরপর বাগুইআটি, সলুয়া-নারায়ণপুর, রাজারহাট, শিবতলা(খামার) হল্ট স্টেশন, লাঙলপোতা, হাড়োয়া খাল, খড়িবাড়ি, আমিনপুর, বেলিয়াঘাটা জংশন হয়ে মিশত বসিরহাট-বারাসত লাইনে। স্টিম ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যেত পাঁচ কামরার ট্রেনটিকে। দিনে ছ’বার আপ-ডাউন। বন্ধ হওয়ার কয়েক বছর আগে বাগুইআটি থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত ভাড়া ছ’পয়সা। দমদমের বাসিন্দা প্রথিতযশা চিকিৎসক অলককুমার গুহ বলেন, ‘তখন আমার দশ বছর বয়স। অবাক হয়ে দেখতাম কু-ঝিক ঝিক করে ট্রেন যাচ্ছে। কত মানুষ যাতায়াত করতেন। খুব শখ ছিল চড়ার। কিন্তু ওঠা হয়নি।’
ব্যবসায়ী টমাস অ্যাকুইনাস মার্টিন বাঙালি উদ্যোগপতি স্যার রাজেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মার্টিন লাইট রেলওয়ে তৈরি করেছিলেন। তারা বাংলা, বিহার ও অসমে রেলপথ স্থাপন করেছিল। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘বারাসত-বসিরহাট লাইট রেলওয়ে’। ১৯০৫ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি বারাসত-বসিরহাট লাইনে প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু। বসিরহাট থেকে হাসনাবাদ সংযোগ ১৯০৯ সালের দুই মার্চ। বেলিয়াঘাটা ব্রিজ থেকে পাতিপুকুর পর্যন্ত চলল ১৯১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। পাতিপুকুর থেকে বেলগাছিয়া (শ্যামবাজার স্টেশন) পর্যন্ত ১৯১৪ সালের দুই অক্টোবর। ১৯৫৫ সালের এক জুলাই শেষবার চলল ট্রেন। তারপর পাকাপাকিভাবে বন্ধ চলাচল। অনেকে স্মৃতিপথ হাতড়ে এখনও বের করেন মার্টিনের ‘খেলনাগাড়ি’। চোখ বড় করে সে গল্প শুনতে এখনও বসে ১১৫ বছর পরের কলকাতা।