দিন তিনেক আগেই নদিয়ার শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের একটি ঘটনায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে এক শিশুরোগী মেঝেতে বমি করে ফেলায় তারই বাবাকে দিয়ে বমি সাফ করানোর অভিযোগ উঠেছে কর্মরত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। ব্যথিত বাবা এ নিয়ে হাসপাতালের সুপারের কাছে অভিযোগও জানিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, কেনই বা পরিজনকে বমি পরিষ্কার করতে হলো? কোথায় ছিলেন সাফাই কর্মী? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ওই ঘটনায় বেআব্রু হয়ে গিয়েছে সরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মিসঙ্কটের ছবিটা।
দেখা যাচ্ছে, শুধু শান্তিপুরের ওই হাসপাতাল নয়, সরকারি হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের ভয়াবহ শূন্যপদ ছেয়ে রয়েছে গোটা রাজ্যেই। স্বাস্থ্য দপ্তরের নথি বলছে, সরকারি হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের প্রায় ৬৭% পদই খালি। আর শুধু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ধরলে, সেই শূন্যপদ ৮০% ছুঁইছুঁই।
এখানে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী বলতে মূলত জেনারেল ডিউটি অ্যাটেন্ডেন্ট (জিডিএ) বা পূর্বতন পিওন এবং কর্মবন্ধু বা পূর্বতন সাফাইকর্মীর কথাই বলা হচ্ছে। ডোম পদকে ধরা হয়নি এই হিসেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরাই নন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাও যে সুষ্ঠু হাসপাতাল পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো শান্তিপুর। একাধিক সরকারি চিকিৎসক সংগঠনের করা আরটিআই-এর জবাবে স্বাস্থ্য দপ্তর নিজেই জানিয়েছে, সারা রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জিডিএ পদে ৬৫.৫৯% এবং কর্মবন্ধু পদে ৬৮.০৯% শূন্যপদ রয়েছে।
অর্থাৎ, যত লোক কর্মরত, তার চেয়ে শূন্যপদের বহর আরও বেশি। ছবিটা আরও করুণ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রাজ্যের ৩২টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ এবং তার সংলগ্ন হাসপাতালে জিডিএ পদে ৭৮.৮০% এবং কর্মবন্ধু পদে ৮০.১১% শূন্যপদ রয়েছে। অনুমোদিত জিডিএ পদ ৬,২৬৯টি। আছেন ১,৩৭৫ জন এবং শূন্যপদ ৪,৮৯৪টি। অর্থাৎ কর্মরতের সাড়ে তিন গুণ শূন্যপদ। আর অনুমোদিত কর্মবন্ধু পদ ২,৯৮৭টি। আছেন মাত্র ৬৭৮ জন এবং শূন্যপদ ২,৩০৯টি। এ ক্ষেত্রেও ‘আছে’র সাড়ে তিন গুণ ‘নেই’ দেখা যাচ্ছে।
ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রোগী বমি করে ফেললে কিংবা চ্যানেল করতে গিয়ে মেঝেয় রক্ত পড়লে, সে সব পরিষ্কার করার জন্য শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের মতোই সাফাই কর্মীর দেখা মেলে না। সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, ‘জিডিএ এবং কর্মবন্ধুরা স্বাস্থ্য পরিষেবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ওঁদের কাজের তালিকা লম্বা। ওঁরা ছাড়া সব হাসপাতাল কার্যত অচল। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— সবই করেন এই স্তরের কর্মীরা। কিন্তু দীর্ঘ দিন কোনও নিয়োগ নেই। ফলে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায়।’
একই সুর সরকারি চিকিৎসকদের আর এক সংগঠন সার্ভিস ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাসের গলায়। তিনি বলেন, ‘শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে এই অভাব আরও বেশি প্রকট। মুশকিল হলো, অনুমোদিত পদের যে সংখ্যাটা ধার্য রয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরে, সেই সংখ্যা স্থির করা হয়েছে শেষ ১৯৯১ সালের জনগণনার ভিত্তিতে। অথচ, বিপুল জনসংখ্যা এর মধ্যে যেমন বেড়েছে, তেমনই চটকদার বিনামূল্যের চিকিৎসার প্রচারের জেরে সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা সেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতের চেয়েও অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।’
মানস মনে করেন, স্থায়ী নিয়োগের বদলে যে চুক্তির কর্মী দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে, সেই সংখ্যাটাও অপ্রতুল। তাঁর কথায়, ‘ভবন আর যন্ত্রপাতি থাকলেই চিকিৎসা হয় না। প্রয়োজন, চিকিৎসা ব্যবস্থা সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য সব স্তরের পর্যাপ্ত কর্মী।’ সজল জানাচ্ছেন, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী নয়, শুধুমাত্র চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর অভাবে অস্ত্রোপচার পিছিয়ে যাচ্ছে, এমন নজিরও তাই বাংলার সরকারি হাসপাতালে দেখা যায় প্রায়শই।