সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে এ বার মঞ্চ তৈরি করল ‘শিয়ালগিরি’ সম্প্রদায়। নাম দেওয়া হল ‘বঙ্গীয় শোয়ালগিরি সংরক্ষণ সমিতি।’ সমিতির মাধ্যমে জাতিগত শংসাপত্র লাভের আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে চায় তাঁরা।
কিন্তু কারা এই ‘শিয়ালগিরি’ বা শোয়ালগিরি? নবগঠিত সমিতির সভাপতি গিরিশচন্দ্র পাত্র এবং সম্পাদক নিরঞ্জন পাত্রদের দাবি, তাঁরা তফসিলি উপজাতির। বহুকাল আগে পূর্বপুরুষেরা থাকতেন জঙ্গল ও জঙ্গল লাগোয়া এলাকায়। পেটের দায়ে চুরি-ডাকাতির সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। তখন ইংরেজ শাসন।
ইংরেজ পুলিশের ধরপাকড়ের জন্য তল্লাশি চালালে পদবি বদলে ফেলতেন পুলিশকে ধোকা দিতে। পদবি বদলে ফেলার পাশাপাশি নিজেদের ম্লেচ্ছ তকমা ঘোচাতে সংস্কৃতিও ভুলতে বসেন। মিশে যান সাধারণের ভিড়ে। গিরিশচন্দ্র পাত্রের কথায়, ‘আমরা সংখ্যায় খুবই কম। অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতেই নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ভুলে সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম। বর্তমান প্রজন্ম তো আমাদের সংস্কৃতি-ভাষা কিছুই জানে না। আমরা তফসিলি উপজাতির তকমা ফিরে পেতে চাই।’
এই লুপ্তপ্রায় শিয়ালগিরি সম্প্রদায়ের দেখা মেলে কেবল বাংলা-ওডিশা সীমান্তে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন ও মোহনপুর ব্লকের কয়েকটি জায়গায় তাঁরা এখনও রয়ে গিয়েছেন। লাগোয়া ওডিশাতেও রয়েছেন। পেশায় শিক্ষক তথা দণ্ডভুক্তি অ্যাকাডেমির সম্পাদক সন্তু জানা ‘মেদিনীপুরের বিলুপ্তপ্রায় জনজাতি শিয়ালগিরি’ নামে একটি গবেষণাধর্মী বইও লেখেন। ইতিহাস গবেষক জর্জ গ্রিয়ারসনের ‘লিঙ্গুইসটিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থেও শিয়ালগিরি সম্প্রদায়ের ভাষার সামান্য উল্লেখ রয়েছে। তা হল, ‘এক মরদনা বে দিকরা থেই। তিহ্নে বিচে নানহে দিকরা আপনু বাবানে কহে, বাব, মারো হিঞ্চ মার দে...।’ এই ভাষা বুঝে তার বাংলা তর্জমা করেন সোলপাট্টা গ্রামের ভজহরি পাত্র, যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘একজন পুরুষের দু’জন ছেলে ছিল। তিন জনের মধ্যে ছোট ছেলেটি বলল, বাবা, আমার সম্পত্তি আমায় দিয়ে দাও।’
১৯৫১ সালের জনগণনার তথ্যেও ‘শিয়ালগিরি’ সম্প্রদায়ের উল্লেখ রয়েছে। দাঁতন থানার নিমপুর, বরঙ্গি, সোলপাট্টা এবং মোহনপুর থানার গোমুন্ডা, পাঁচকনিয়া প্রভৃতি এলাকা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার শিয়ালগিরি মানুষের বসবাস। ‘বঙ্গীয় শোয়ালগিরি সংরক্ষণ সমিতি’-র মুখ্য উপদেষ্টা সন্তু জানা বলেন, ‘বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায় থাকা বিলুপ্তপ্রায় শিয়ালগিরি উপজাতির মানুষগুলির প্রকৃত জাতিগত অধিকার আদায়ের দাবিতে দীর্ঘদিন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দাবি জানিয়ে এসেছি। আমরা চাই, এঁদের সংরক্ষণের আওতায় আনা হোক।’
সম্প্রতি, ওডিশা সরকার এই সম্প্রদায়ের মানুষকে সবাখিয়া, সুয়ালগিরি বা সোয়ালগিরি নামে চিহ্নিত করে তফসিলি জাতির তকমাও দিয়েছে।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুমহান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘শিয়ালগিরি সম্প্রদায় বাংলা ও বিহারে বিভিন্ন পরিচয়ে রয়েছে। ওদের ভাষার সঙ্গে গুজরাটি ভাষারও কিছু মিল রয়েছে।’ দাবির ব্যাপারে দাঁতনের তৃণমূল বিধায়ক বিক্রমচন্দ্র প্রধান বলেন, ‘আমি বিষয়টি তফসিলি উপজাতি দফতরে জানিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীকেও জানিয়েছি। আবারও জেলাশাসকের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব।’