• সামনে উচ্চ মাধ্যমিক, ধূপ বিক্রি করে পড়ার খরচ তোলে মন্দিরা
    এই সময় | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • আশিস নন্দী, মছলন্দপুর

    ৩ মার্চ, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শুরু। আর দশটা মেয়ে হয়তো রণে ভঙ্গ দিত। কিন্তু, মন্দিরার মতো কিছু মানুষ জন্মায়, যাদের জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায় অনমনীয় জেদ। বয়স মাত্র ১৭ বছর হলেও বা। বাপ–মায়ের অভাবের সংসার পথে নামিয়েছে মন্দিরাকে। কারণ, সে পড়তে চায়। সেটাই তার জেদ। ৩ তারিখ পরীক্ষায় বসতে হবে তো!

    সেই জেদটুকু বুকে নিয়ে ধূপকাঠি ফিরি করছিল পথে পথে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। চোখ দু’টি ভারী উজ্জ্বল। চেহারাও ঝকঝকে। সাদামাটা কুর্তা, টেনে বিনুনি বাঁধা। চোখে পড়ে যায় উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুর বাজারের কিছুু ব্যবসায়ীর। পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়ার তার এই অদম্য প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানিয়ে ব্যবসায়ীরা ১০ হাজার টাকা তুলে তার সঙ্গে বোর্ড, পেন এবং জলের বোতলও উপহার দিয়েছেন মন্দিরাকে।

    পরীক্ষার বেশি দেরি নেই। যাদের মসৃণ জীবনে এই লড়াইয়ের গল্পগুলো ভীষণই অপ্রাসঙ্গিক, তারা ঘেরাটোপে বসে নিশ্চিন্তে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। নম্বরের দৌড়ে কোথায় পৌঁছবে, টেনশন মূলত তা নিয়েই। মন্দিরাদের গল্পটা ভিন্ন। তারা ইঁদুর দৌড়ে থাকে না। তাদের পিছনে দৌড়তে থাকে অযাচিত সমস্যা, অনটন। তবু জিততে চায় মন্দিরারা। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের বাড়ি থেকে প্রায় ৩০–৩৫ কিলোমিটার উজিয়ে অপরিচিত পরিবেশে চারটে ধূপকাঠি বিক্রি করে সেই টাকায় নিজেই টিউশন পড়ে। বাকি টাকা তুলে দেয় মায়ের হাতে।

    মন্দিরার বাড়ি বারাসত পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বনমালীপুরে। বাবা সাহেব সিংহ লটারির টিকিট বিক্রি করেন। মা পাপিয়া গৃহবধূ। ছোট ভাই চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া। জরাজীর্ণ বাড়িতে খুঁড়িয়ে সংসার চলে লটারির টিকিট বিক্রির আয়ে। দু’বেলা চারজনের মুখে খাবার তুলে দেওয়াটাই সাহেবের কাছে চ্যালেঞ্জ। সেখানে দাঁত চেপে লড়াই করে মন্দিরা মাধ্যমিকে প্রথম ডিভিশন পায়। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার খরচ আরও বেশি।

    সংসার সামলে সাহেবের পক্ষে মন্দিরার প্রাইভেট টিউটরের খরচ টানা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে ঘুরে ঘুরে ধূপকাঠি বিক্রি শুরু করেছিল মন্দিরা। নিজের শহরে, এলাকায় ঘুরে ঘুরে ধূপ বেচতে অস্বস্তি হয়। তাই বারাসত বাদ দিয়ে কখনও হাবরা, কখনও দত্তপুকুর, কখনও আবার মছলন্দপুর, নিউ ব্যারাকপুর, বিরাটিতে ঘুরে ধূপকাঠি বিক্রি করে সে।

    কেমন তার দিনযাপন?

    সকালে উঠে কিছুক্ষণ পড়ে নেয়। সামান্য কিছু মুখে তুলে এর পরে ধূপের প্যাকেট হাতে বেরিয়ে পড়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত টো টো করে ঘোরা। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে ফের পড়তে বসা। গত একবছর এটাই তার রোজনামচা। গড়ে রোজ বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার ধূপকাঠি। কেনার খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন লাভ হয় ৬০ থেকে ৭০ টাকা। কতই বা হয় তাতে? মেরেকেটে হাজার দুয়েক। প্রতি মাসে সেখান থেকেই একাধিক প্রাইভেট টিউটরের বেতন সরিয়ে রেখে বাড়তি সামান্য টাকা মায়ের হাতে তুলে দেয়। হাতে গোনা আর কয়েকটা দিন বাকি পরীক্ষার। তবুও ধূপকাঠি বিক্রিতে বিরাম দিতে পারে না মন্দিরা।

    মছলন্দপুর বাজারে সাইকেল গ্যারাজ রয়েছে বিশ্বজিৎ কুণ্ডুর। শনিবার মন্দিরাকে ধূপকাঠি বেচতে দেখে কথায় কথায় জীবনযুদ্ধের কাহিনি জানতে পারেন তিনি। স্থানীয় ব্যবসায়ী সুজিত সাহাকে সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়েন পথে। মন্দিরার থেকে নম্বর নিয়ে তার মা পাপিয়াকে ডেকে নেন মছলন্দপুর বাজারে। চাঁদা তুলে তাঁর হাতেই নগদ তুলে দেন ব্যবসায়ীরা। মন্দিরা বলছে, ‘পড়ার খরচ সামলাতেই ধূপকাঠি বিক্রি শুরু করেছিলাম। কলেজের পড়া শেষে চাকরি করে মা–বাবাকে সাহায্য করতে চাই।’ বিশ্বজিতের কথায়, ‘এতটুকু মেয়ের লড়াইয়ের কথা শুনে আমাদেরও কষ্ট হয়েছে। ও যাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, তার জন্য চেষ্টা করব।’

    মায়ের চোখে জল। বলেন, ‘প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। এখন তো অনেক রকমের ঘটনা শুনি। কিন্তু অভাবের জন্যই মেয়েটাকে ছাড়তে হয়েছে। সকাল–সন্ধ্যায় পড়াশোনাটা মন দিয়ে করে।’ গর্বে ভরে ওঠে মায়ের বুক — ‘ধূপকাঠি বিক্রির টাকা দিয়ে নিজের পড়ার খরচটা সামলে তো নিচ্ছে!’

    মন্দিরা বলছে, ‘ধূপকাঠি বিক্রি করার সময়ে বহু মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে অস্বস্তি হয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম, ভয় পেলে, ঘাবড়ে গেলে চলবে না।’ অন্যরা ৩ মার্চ থেকে পরীক্ষা দেবে। মন্দিরার পরীক্ষা প্রতিদিনের।

  • Link to this news (এই সময়)