কাটি সার্ক।
বাতাস কেটে ভেসে যায় সাগরে। উঁচু তার মাস্তুল। ১৫৬ বছর আগে প্রথম জলে ভাসে ব্রিটিশ এই জাহাজ। সেই ১৮৬৯–তে চিন থেকে সমুদ্রপথে ইংল্যান্ডে চা আনতে শুরু করে সে। পরে অস্ট্রেলিয়া থেকে রাশি রাশি উলও আনত। ব্রিটিশদের সেই গর্বের জাহাজ এক বুক ইতিহাস নিয়ে একদিন থেমে যায়। কিন্তু, ফুরিয়ে যায় না।
রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথের নির্দেশ আসে। ব্রিটিশ ঐতিহ্যের নিদর্শন হয়ে মাস্তুল উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে কাটি সার্ক। লন্ডনের কাছে গ্রিনউইচ–এ ১৯৫৭ থেকে আজও তার শরীরে হাত বুলিয়ে ঘুরে বেড়ান পর্যটকের দল। মাঝে ২০০৭–এ আগুন লেগে যায় কাটি সার্ক–এ। বন্ধ হয়ে যায় প্রদর্শন। আশঙ্কা ঘনীভূত হয়। কিন্তু, জিদ্দি ব্রিটিশ আবার ঘষে–মেজে, সংস্কার করে সাত বছরের ব্যবধানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাকে।
কলকাতা বন্দরে পড়ে রয়েছে এমনই এক অনামী কাটি সার্ক। সবার অলক্ষ্যে, অনাদরে। না, সে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পণ্য আনেনি কখনও। কিন্তু, দিনের পর দিন কলকাতার বন্দরের কাছে নোঙর করা বিদেশি জাহাজের নাবিকদের পিপাসা মিটিয়েছে সে। কাটি সার্কের মতো তার কোনও নাম নেই। তাই বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে সে কোথাও সেজেগুজে দাঁড়িয়ে নেই। উল্টে দুয়োরানির পুত্রের মতো দিন কাটে তার।
১৮৭১–এর কথা। ইতিহাস বলছে, তবে থেকে শহরে পরিস্রুত জল সরবরাহের শুরু। তার কিছুদিন পর থেকে সেই জল নৌকায় ভরে জাহাজে পৌঁছে দিত কলকাতা পুরসভা। বাগবাজার থেকে বাবুঘাট — গঙ্গার তীর বরাবর ঘাটে তখন দেশ–বিদেশের বহু জাহাজ এসে ভিড়ত। এখন আর সেখানে জাহাজ আসে না। এখন জাহাজ ভেড়ে খিদিরপুর বন্দরে। তখন পণ্য জাহাজ যেমন ছিল, তেমনই ছিল যাত্রিবাহী জাহাজ। ঘাটে কয়েকদিন নোঙর করত তারা। আবার কিছু বড় বড় জাহাজ মাঝ নদীতেও নোঙর করত। সেই সব জাহাজের নাবিকদের পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা হতো নৌকো করে। পলতা ও টালার পানীয় জল নল বেয়ে পৌঁছত বিভিন্ন ঘাটে। নৌকোয় সেই জল ভরা হতো। নৌকোয় পাম্প থাকত। তার সাহায্যে উঁচু জাহাজে তুলে দেওয়া হতো জল।
সময়ের সঙ্গে সেই নৌকোর বদলে আসে বড় বজরা। পুরসভার প্রাক্তন ডিজি (ওয়াটার সাপ্লাই) বিভাস মাইতি বলছেন, ‘২০১০ পর্যন্ত সেই বজরা কাজ করেছে। এম ভি হর্ষবর্ধন জাহাজে জল সাপ্লাই করা হয়েছে। তারপরে বন্ধ হয়ে যায়।’ এই বজরার মাঝি–মাল্লা, সারেঙ — এঁরা একসময়ে ছিলেন কলকাতা পুরসভার বেতনভুক কর্মী। ধীরে ধীরে তাঁঁদেরও নামও কাটা পড়তে থাকে পুরসভার জাবদা খাতা থেকে। কালের নিয়মে বজরার সংখ্যা তিন থেকে একে নেমে আসে। বাতিল হয়ে যাওয়া শেষ বজরাটির স্থান হয় খিদিরপুর বন্দরে। সেই বন্দরের মালিকানা চলে গিয়েছে কেন্দ্রের অধীনস্থ কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট (সিপিটি)–এর হাতে। মুখ ফিরিয়েছে পুরসভা। তাই যে বজরাকে সযত্নে সাজিয়ে রাখা যেত, সে এখন শুধুই বিড়ম্বনা।
বর্তমানে পোর্ট ট্রাস্টের জমি দখল করে ‘মধুমাঝির’ নৌকোর মতো মুখ বুজে পড়ে আছে সে। আর কারও কোনও কাজে লাগছে না। উল্টে কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দরের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কথা গত কয়েক বছরে বার বার পত্রাঘাতে পুরসভাকে জানিয়েও কোনও ফল পাননি বন্দর কর্তারা। শেষ চিঠিটি এসেছে এই বছরের জানুয়ারিতেই। সেখানে লেখা —‘পড়ে থাকা ওই বজরার জন্য আমাদের দৈনন্দিন কাজে অসুবিধে হচ্ছে।’ ১৩ জানুয়ারির ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পুরসভা ১৫ দিনের মধ্যে যোগাযোগ না–করলে ব্যবস্থা নেবে তারা।’
পোর্টের এক কর্তা জানিয়েছেন, পুরসভার বজরাটি বন্দরের গায়ে জলের উপরেই দাঁড়িয়ে ছিল। ২০১৬–র ২৯ জুন যাত্রিবাহী এম ভি নিকোবর জেটিতে ভিড়তে গিয়ে ভুল করে ধাক্কা মারে তাকে। ডুবে যায় বজরাটি। এরপরে সেটিকে জল থেকে তুলে ডাঙায় রাখা হয়। তবে থেকে ওখানেই পড়ে। ওই কর্তার কথায়, ‘ওই এলাকাটি আমাদের পণ্য রাখার জায়গা। ফলে অসুবিধে হচ্ছে। কিলো দরে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। তবে, সম্প্রতি পুরসভা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।’
কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, গত ৩ জানুয়ারি পুরসভার একটি দল বন্দরে গিয়ে দেখে এসেছে বজরাটি। সেই দলে ছিলেন পুরসভার অতিরিক্ত কমিশনার প্রবালকান্তি মাইতি। তাঁর কথায়, ‘যে অবস্থায় দেখে এসেছি, তাকে আর কখনও দাঁড় করানো যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’ এক পুরকর্তার কথায়, ‘লোহা–লক্কড়ের দরে সেটিকে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তারই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।’ আগামীতে কিলো দরে বিকিয়ে যাবে বাংলার ইতিহাসের এই স্মারক।
কেন ফুরোলো প্রয়োজন?
কমে গিয়েছে জাহাজের সংখ্যা
জাহাজ নিজেই রিভার্স অসমোসিস (আরও) করে চাহিদা মেটাচ্ছে
সিপিটি নিজেই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করে জল সরবরাহ করছে