সৌমিত্র ঘোষ, ডোমজুর
‘তারে জমিন পর’ ছবিতে ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ঈশান অবস্থিকে তার জগৎ চিনতে সাহায্য করেছিলেন তাঁর স্কুলের শিক্ষক। ডোমজুড়ের আদিত্য নস্করের গল্পেও ঈশানের লড়াইয়ের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ছোট থেকেই বিশেষ ভাবে সক্ষম আদিত্যের কথা বলা ও কানে শোনার সমস্যা ছিল।
তাঁর চিকিৎসার সব রকম চেষ্টা চালান আদিত্যর অভিভাবকরা। স্কুলে নিজেকে খুব একা লাগত তাঁর। বন্ধুরা কেউ এগিয়ে এসে মিশত না তাঁর সঙ্গে। তবে ছোট থেকেই নিজের ছবি আঁকার জগতেই অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করেছেন আদিত্য। সম্প্রতি রাজ্যের যুব কল্যাণ দপ্তরের আয়োজিত ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় আদিত্য প্রথম হয়েছেন। এ ভাবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরে এখন অনেকটাই আত্মবিশ্বাসী এই শিল্পী।
যুবকল্যাণ দপ্তরের উদ্যোগে আয়োজিত রাজ্যভিত্তিক আঁকা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে সকলকে অবাক করেছেন ডোমজুড়ের মূকবধির তরুণ আদিত্য নস্কর। ডোমজুড়ের বেগড়ির বানিয়াড়ার ২১ বছরের আদিত্য এ বার হাওড়া জেলায় ব্লক স্তরের প্রতিযোগিতাতে প্রথম হয়ে রাজ্যের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
গত ২৩ জানুয়ারি সল্টলেক স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠান মঞ্চে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের হাত থেকে তিনি পুরস্কার নেন। আদিত্য জানিয়েছেন, ছবি আঁকাকেই তিনি ভবিষ্যতের পেশা হিসেবে নিতে চান। আদিত্যকে এই প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে উৎসাহিত করেছেন আদিত্যের অঙ্কন শিক্ষক ডোমজুড় 'ওপেন স্কাই'–এর কর্ণধার শিল্পী মৃণাল মাইতি। মৃণালের প্রশিক্ষণ ও উদ্যোগেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন আদিত্য। এ বার রাজ্যের প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের কোনও একটি দিক।
আদিত্য তাঁর পেন্সিল আর রঙ–তুলিতে বিবেকানন্দের বাণী থেকে ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ এই ভাবনায় ছবি এঁকেছেন। আর তাতেই চমক লাগিয়েছেন তিনি। রাজ্যভিত্তিক প্রতিযোগিতায় ২৫০ প্রতিযোগীর মধ্যে ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রথম পুরস্কার। আদিত্যর শিক্ষক মৃণাল বলেন, ‘স্পিচ থেরাপি করে আদিত্য এখন অনেকটা সড়গড়। নিজের কথা বুঝিয়ে বলতে পারেন। কানে শোনার যন্ত্রের সাহায্যে শুনতেও পান কিছুটা। বাকিটা ইঙ্গিতে বুঝতে পারেন।’
তারে জমিনের ঈশান ছিল অন্তর্মুখী, সহপাঠীদের সঙ্গে গল্পগুজব, খেলা বা চুটিয়ে মেলামেশায় তার ছিল অনীহা। ডোমজুড়ের আদিত্য নস্করের সমস্যা একটু বেশি ঘোরতর ছিল। কেননা, ছোটবেলায় আদিত্যর কানে শোনা ও কথা বলাতেও বেশ অসুবিধা ছিল। খুব ছোট বয়সেই তাঁর বাবা–মা বুঝতে পারেন, ছেলের কথা বলার সমস্যা আছে। পরে বোঝা যায়, সে কানেও শুনতে পায় না। চিকিৎসকের পরামর্শ নেন তাঁরা।
সেই থেকেই নিতান্ত নিম্নবিত্ত দম্পতির যুদ্ধ শুরু ছেলেকে নিয়ে। তবে তাঁরা কখনওই আদিত্যকে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের স্কুলে ভর্তির কথা ভাবেননি। সে সামর্থ্যও ছিল না তাঁদের। আদিত্য আর পাঁচটা স্বাভাবিক ছেলের সঙ্গে বাড়ির কাছাকাছি সাধারণ স্কুলেই লেখাপড়া শিখেছেন। সেখান থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়েছেন।
অনেক বাধা ছিল স্কুলেও। ছোট থেকেই কথা বলার অসুবিধা ও কানে শোনার অক্ষমতার জন্য বন্ধুরা আদিত্যকে এড়িয়ে চলত। সে জন্য মনোকষ্টে ভুগতেন শিশু আদিত্য, জানিয়েছেন তাঁর মা শুভ্রা নস্কর।
এত কিছুর পরেও তাঁর ভিতরের সৃজনশীলতা বিকশিত হয়েছে তাঁর নিজের ও অভিভাবকদের চেষ্টায়। স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি আদিত্য আঁকা শেখা শুরু করেছিলেন। গত কয়েক বছর শিল্পী মৃণালের প্রশিক্ষণে আদিত্য এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। আগামীতে তাঁর আকাশেও অজস্র তারা ফুটে উঠুক, এমনই চান শুভাকাঙ্ক্ষীরা।