পার্থ দত্ত
শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?’
৩৯ বছর ধরে ইউএসএ–তে কাটানো নিউ ইয়র্কের প্রবাসী বাঙালি অমিত গুহের কাছে কিন্তু এই কবিতার লাইনটা একটু অন্য রকম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীর কথা, ‘যেতে পারি, তাই নিশ্চিত যাব।’
অমিতের কাছে যেথা খুশি সেথা যা—ব্যাপারটা যে কতটা সত্যি, তা তাঁর মহাকুম্ভ স্নান করতে আসার ঘটনাতেই পরিষ্কার। প্রায় ১২৪০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে মাত্র এক দিনের জন্য ভারতে এসে মঙ্গল–ঊষাতে তিনি ডুব দিয়েছেন প্রয়াগের সঙ্গমে। তারপরে এ দিনই আবার সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার উড়ে গিয়েছেন নিউ ইয়র্কের পথে।
হৃদরোগ সংক্রান্ত সমস্যার জন্যই গত বছর বছর পঁয়ষট্টির অমিতের বুকে স্টেন্ট বসেছে। নিউ ইয়র্কের ডাক্তারের কঠোর নির্দেশ, কমপক্ষে এক বছর দীর্ঘ বিমানযাত্রা করা যাবে না। তাতে রক্তচাপ বাড়তে পারে। ক্ষতি হতে পারে হৃদযন্ত্রে। কিন্তু মহাকুম্ভ স্নানের ইচ্ছাপূরণে তিনি ডাক্তারের নির্দেশ অমান্য করে নিউ ইয়র্ক থেকে টানা ১৪ ঘণ্টা বিমানযাত্রা করে নয়া দিল্লিতে আসেন। সেখান থেকে ফের বিমানে বারাণসী। তারপরে সেখান থেকে পাঁচ ঘণ্টা টানা গাড়িতে প্রয়াগ। তারপর রাতারাতি একই ভাবে ফের নিউ ইয়র্কে ফেরা।
মঙ্গলবার ভোরে স্নান সেরেই গাড়িতে করে প্রয়াগ থেকে বারাণসী আসার পথে ফোনে অমিত মজা করেই বলছিলেন, ‘এ বার কুম্ভে স্নান না করলে তো ১৪৪ বছর অপেক্ষা করতে হত!’ যোগ করেন, ‘আমার স্ত্রী স্মিতা ও দুই মেয়ে অমৃতা ও আনন্দিতা আমাকে আটকাতে চেয়েছিল। ডাক্তারের নির্দেশ মনে করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমি ওদের বোঝাই যে, আমাকে আমার বড় ডাক্তার (পড়ুন ঈশ্বর) যখন কুম্ভ স্নানের অনুমতি দিয়েছেন, তখন আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।’ অমিত অবশ্য ভারতে এসে সময় নষ্ট করেননি। স্ত্রী–কে কথা দিয়েছিলেন, ‘রবিবার তোমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খেয়ে যাচ্ছি। মাঝে সোম ও মঙ্গল থাকছি না। বুধবারে ফিরে তোমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব।’ নিউ ইয়র্কের সময়ে বুধবার সকাল সাড়ে সাতটায় তাঁর নিউ ইয়র্কের বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার কথা অমিতের।’ তাঁর স্বপ্নপূরণে অমিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাঁর তিন বন্ধু বিজয় ভকত, সঞ্জয় দত্ত আর বিশ্বজিৎ করের কাছে। অমিতের মন্তব্য, ‘এদের উৎসাহ ও সাহায্যেই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুণ্য সঞ্চয় করতে পারলাম। প্রয়াগে রাত কাটিয়েছি এনটিপিসি–র তাঁবুতে। এই সংস্থার ছেলেপুলেরাও আমাকে খুব ভরসা দিয়েছে।’
৭২ ঘণ্টার এই ঝটিকা সফরে অমিত তাঁর ছোট্ট হ্যান্ড লাগেজে এনেছিলেন নিয়মিত খাবার কয়েকটা ওষুধ। ভিসা–পাসপোর্ট সহ কাগজপত্র। সঙ্গে হরেকৃষ্ণ নামাবলি ও বজরংবালির ছবি। কুম্ভে ডুব দেওয়ার ধুতিটাও কিনেছেন প্রয়াগ থেকেই। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে তিনটেয় ডুব দেওয়ার আগে মাথাও মুড়িয়েছেন। যাওয়ার সময় নিয়ে গেলেন বেশ কিছুটা গঙ্গা মাটি আর তিন আউন্সের ছোট ছোট শিশিতে কুম্ভের জল। অমিতের কথায়, ‘আমেরিকায় আমার কাছে অনেকে মহাকুম্ভের জল আনার আব্দার করেছেন। কিন্তু বিমানে তো ১০০ মিলিলিটারের বেশি লিকুইড নিয়ে যেতে দেবে না। তাই তিন আউন্সের কয়েকটা শিশিতে জল নিয়ে যাচ্ছি। আর গঙ্গা মাটি থাকবে আমার উপাসনা বেদিতে।’
যাদবপুরের ৮–বি বাসস্ট্যান্ডের অদূরেই অমিতদের আদি বাড়ি। সাউথ পয়েন্টে তাঁর ক্লাসমেট ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ ও নোবেল লরিয়েট অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে সর্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল মিটে খেলতে গিয়ে কিংবদন্তি মজিদ বিশকরকে কলকাতায় তুলে আনার পিছনেই ছিল তাঁর বড় অবদান। এখান থেকেই ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনার পরে ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি দেন ইউএসএতে। তার পরে দেখতে দেখতে চার দশক তিনি সেখানকারই বাসিন্দা। এখন তিনি পিৎজা সেন্টার চালান। সঙ্গে বাচ্চাদের স্কুলও রয়েছে। গড়ে তুলছেন বৈদিক পঠনপাঠন সেন্টার। সমাজসেবার জন্য ওই দেশে এর মধ্যেই তিনি ভীষণ জনপ্রিয়। ঘোরতর কোভিডের সময় গায়ে নামাবলি চড়িয়ে নিজের গাড়িতে করে হাসপাতাল ও দমকল কর্মীদের টানা ১০০ দিন তিনি পিৎজা বিলিয়ে এসেছিলেন। এখন প্রতি শনিবার একটি মানসিক প্রতিবন্ধী শিবিরে গিয়ে ৬৮ জনকে বিনা অর্থে পিৎজা খাইয়ে আসেন তিনি।
এত সবের পরেও দেশের প্রতি তাঁর অসম্ভব টান। প্রতি বছর শীতে দেশে ফিরে যাদবপুরের বাড়িতে হিন্দু ধর্ম নিয়ে নানা পূজার্চ্চনার পাশাপাশি আলোচনা চক্রে ডাকেন বাংলার ধর্মীয় গুরুদের। ডুয়ার্স থেকে সুন্দরবনের নানা সমাজসেবী সংস্থাকে সাহায্যও করেন নীরবে।
আর এত সবের মধ্যেও তিনি প্রয়াগে এলেন, কুম্ভে ডুব দিলেন, পুণ্য সঞ্চয় করে নিউ ইয়র্কেও ফিরে গেলেন।