• ফাইট... বেবি ফাইট, একটাই মন্ত্র বৈশালীর
    এই সময় | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • এই সময়, ময়নাগুড়ি: পড়াশোনা কতদিন চালিয়ে যেতে পারবেন, সেটাই ছিল অস্পষ্ট। অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে করতে জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ির বাসিন্দা বৈশালী সাহা এখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গবেষক। শুধু তাই নয়, তাঁর গবেষণার ঝুলিতে দু'টি ওষুধও রয়েছে। হারপিস ভাইরাসের জন্য যে ড্রাগ ব্যবহার হয় সেটাকেই ইনক্লুসন করে জেল তৈরি করেছেন তিনি। এর ফলে হারপিস নিরাময়ের জন্য রোগীকে যেমন দিনে তিন বার ওষুধ খেতে হতো, তার বদলে ওই জেলটি দিনে একবার লাগালেই রোগ নিরাময় হবে।

    পাশাপাশি ট্যাবলেট খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাবেন রোগী। তাঁর আরেকটি উদ্ভাবন ফুড ডাই। বিভিন্ন পানীয় এবং মেডিসিনে রং করার ক্ষেত্রে এই ডাইয়ের প্রয়োজন হয়। পানীয়তে নানা ধরনের রং ব্যবহার করা হয়। তার ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। আর ক্যান্সারের ওষুধে এই ডাই ব্যবহার করে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলিকে মেরে ফেলাটা সহজ হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরের ১২টি জার্নালে তাঁর গবেষণার বিষয়গুলি প্রকাশিত হয়েছে।

    অথচ এমন সফল একটি মেয়ের শৈশবের দিনগুলি ছিল ভয়াবহ। জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি সুভাষনগর পাড়ার বাসিন্দা বৈশালীর এই লড়াইয়ের সেনাপতি ছিলেন তাঁর মা নন্দিতা সাহা। শারীরিক অসুস্থতার জেরে বাবা ঘরবন্দি। ছোট থেকেই তাঁর মা-ই তাঁকে পড়ানোর জন্য নিজে বিভিন্ন কাজ করে খরচ জুগিয়েছেন। কোনও ভাবেই যাতে সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অসুবিধে না-হয়, সে জন্য নিজের গয়না বিক্রি করতে হয়েছে। তার পরেও মাধ্যমিক পাশ করার পরে নিজের ইচ্ছে মতো পড়াশোনা করার সুযোগটা প্রায় হারিয়েই যায়। তাঁর ইচ্ছে ছিল সায়েন্স নিয়ে পড়বেন।

    মাঝখানে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় দারিদ্র। শেষ পর্যন্ত বৈশালীর পাশে দাঁড়ান স্কুলের এক শিক্ষিকা। তিনি বিষয়টি জানার পরে তাঁকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করেন। বইপত্র কিনে দেন। এরপর ওই স্কুলেরই অন্য শিক্ষিকারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। বৈশালী শিক্ষিকাদের নিরাশ করেননি। উচ্চ মাধ্যমিকে জেলায় তৃতীয় হয়ে জলপাইগুড়ি পিডি উইমেন্স কলেজে ভর্তি হন। সেখানে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। স্নাতক পরীক্ষায় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে টপার হন। গ্র্যাজুয়েশনে সর্বোচ্চ র‍্যাঙ্ক করায় খুব সহজেই মাস্টার্স করার সুযোগ মিলে যায়।

    সেখানেও একই সমস্যা। হস্টেল খরচ, খাওয়া দাওয়ার খরচ এ সব জোগাড় করতে এক প্রকার হিমশিম অবস্থা বাড়ির লোকের। এ বার পাশে পেয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। তাঁদের সহযোগিতায় কিছু টিউশন জুটে যায়। তাই দিয়ে নিজের খরচ চালাতে শুরু করেন। অন্য বন্ধুরা যখন কলেজ থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম করতেন, তখন তিনি টিউশন পড়াতে ছুটতেন। সেই শুরু, তারপর গবেষণা। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল 'সুপ্রা-মলিকিউলার হোস্ট-গেস্ট অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড সলিউশন থার্মোডাইনামিক্স'।

    উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স বিভাগের ডিন অধ্যাপক মহেন্দ্রনাথ রায় বলেন, ‘বৈশালী অসাধারণ ছাত্র। খুব ভালো গবেষক। অত্যন্ত সফল ভাবে পিএইচডি করেছে। আমি নিশ্চিত, বৈশালী জীবনে আরও সাফল্য পাবে।’ বৈশালীও চায় নিজেকে শিক্ষার জগতে নিয়োজিত করার পাশাপাশি অন্য প্রান্তিক ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য করতে। বৈশালী বলেন, ‘প্রতিদিন নিজেকে বলতাম, ফাইট বেবি ফাইট। কী করে এতদূরে পৌঁছলাম,এখন অবাক হয়ে ভাবি। এর কৃতিত্ব অবশ্যই আমার মায়ের এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। যে সহায়তা আমি নিজের শিক্ষা জীবনে পেয়েছি, সেটাই আমি সমাজকে ফিরিয়ে দিতে চাই।’

  • Link to this news (এই সময়)