• জীবনানন্দে মেতে প্রেসিডেন্সির নয়া ইনিংস
    আনন্দবাজার | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • ত্রিবেণীর টিস‍্যু পেপার কারখানায় যন্ত্র আর উৎপাদনের ছকে ডিউটি করেই জীবন কেটেছে হেমন্ত মণ্ডলের। এখন ভারী ভারী প্রবন্ধ, উপন‍্যাসে জীবনানন্দের দর্শনের কথা পড়ে মজেছেন সদ‍্য অবসরপ্রাপ্ত সেই শ্রমিক। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শিক্ষাক্রম তাঁর হাতে যেন সোনার খনির দরজা খুলে দিয়েছে।

    ইংরেজি সাহিত‍্যে এমএ সম্প্রীতি ভট্টাচার্য বা পুণেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আধিকারিক সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই সুযোগ লুফে নিচ্ছেন। ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের তালিমে আবৃত্তির চর্চারত সুনন্দার মতে, এই জীবনানন্দ-চর্চা তাঁর মঞ্চ উপস্থাপনাকেও ধারালো করবে। আর শিবপুর আইআইইএসটি-তে জীবনানন্দের জীবনের শেষ পর্বের উপন‍্যাসগুলি নিয়ে গবেষণারত সম্প্রীতির কাছে কয়েকটি মাস সমমনস্কদের সঙ্গে জীবনানন্দে ডুবে থাকার সুযোগটুকুই বিরল প্রাপ্তি।

    নানা বয়সের এমন ৬৩ জন উৎসাহী শিক্ষার্থীর হাত ধরে জীবনানন্দ দাশ মহা সমারোহে ফিরছেন তাঁর নিজের কলেজ প্রেসিডেন্সিতে। জাতীয় শিক্ষানীতি বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের রূপরেখা অনুযায়ী, এ দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলিতে ইদানীং কিছু ‘ভ‍্যালু অ‍্যাডেড কোর্স’ (ভ্যাক)-এর প্রচলন হয়েছে। তাতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ‍্যে এক ধরনের সমন্বয় তৈরি এবং পড়ুয়াদের শিক্ষাগত যোগ্যতা আরও সমৃদ্ধ হওয়ার কথা। আবার এর ফলে শিক্ষাঙ্গনগুলির সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের একটা যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে। সেই প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনানন্দ অধ্যয়ন উদ্যোগটি বিপুল সাড়া ফেলেছে। আজ, বুধবার থেকে যা শুরু হচ্ছে।

    প্রেসিডেন্সির রেজিস্ট্রার দেবজ্যোতি কোনার বলছেন, ‘‘ভ্যাকের সূত্রে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসাহীদেরও আমরা প্রেসিডেন্সিতে পাচ্ছি। আবার প্রেসিডেন্সির বিজ্ঞানের পড়ুয়ারা হয়তো যাদবপুর বা অন্যত্র ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত কোনও পাঠ নিতে পারছেন। ফলে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের সুষম বিনিময় ঘটছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘জীবনানন্দ দাশকে জানার উৎসাহে আমরা অভিভূত। আর কোনও কোর্স এত সাড়া ফেলেনি।’’

    নিজের লেখা নিয়ে সদাকুণ্ঠ, অস্বাভাবিক রকমের স্বভাব-লাজুক জীবনানন্দ বোধহয় তাঁকে নিয়ে তাঁর পুরনো কলেজে এই হইচই স্বপ্নেও ভাবতেন না। বাংলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক ঋতম্ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এই জীবনানন্দ-পাঠের মধ্যে নিবিড় চর্চা, ভাষান্তরের সম্ভাবনা থেকে নাটক, বেতারনাট্য, গান, সিনেমায় জীবনানন্দের অভিঘাত— সবই রাখা হয়েছে। ইদানীং রাজ্য সরকার জীবনানন্দের জন্মদিন স্মরণ করলেও সার্বিক ভাবে জীবনানন্দ কিছুটা অনাদরেই।

    জীবনানন্দের মৃত্যুর প্রায় দু’দশক বাদে তাঁর বাড়ির পরিত্যক্ত ট্রাঙ্ক থেকে লেখকের বিপুল গদ্য সম্ভার উদ্ধারের ঘটনা, বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীদের মতে, বিশ শতকের একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। সম্প্রীতি বলছিলেন, ‘‘মাল্যবান, সুতীর্থ ছাড়া জীবনানন্দের শেষ জীবনের আরও দু’টি উপন্যাস বাসমতীর উপাখ্যান ও জলপাইহাটির সংস্করণগুলি পর্যন্ত ভুলে ভরা, অগোছালো। ভবিষ্যতে এই উপন্যাসগুলির উন্নত সংস্করণ বার হওয়া খুবই দরকার।’’

    প্রেসিডেন্সির এই জীবনানন্দ-চর্চা ভবিষ্যতে একটি জীবনানন্দ গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে বলেও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা মনে করছেন। অতীতে অধ্যাপক তাপস বসু বা তরুণ মুখোপাধ্যায়ের এই চেষ্টা সফল হয়নি। জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি, দিনলিপি, চিঠিপত্র সংরক্ষণও এগোতে পারে। প্রেসিডেন্সির এই শিক্ষাক্রমে প্রবীণ জীবনানন্দবিদ দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডাকারও পরিকল্পনা রয়েছে। জীবনানন্দকে ঘিরে সাহিত্য ও অন্য শিল্পমাধ্যমের যোগাযোগ নিয়ে ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষ প্রমুখকে ডাকা হতে পারে। ছ’মাসের অনলাইন, অফলাইন জীবনানন্দ চর্চা শেষে পরীক্ষা দেবেন শিক্ষার্থীরা।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)