পিনাকী ধোলে, আড়ষা: সময় এলেই ভোট চাইতে নেতারা চলে আসেন গ্রামে। শুধু গ্রামে এসে পৌঁছয় না পরিস্রুত পানীয় জল। তাই আজও পাহাড়ী ঝর্ণা, কিংবা পাহাড়ী নদীর পাশে গর্ত খুঁড়ে, তা থেকে জল সংগ্রহ করতে হয় বাসিন্দাদের। তারপর সেই জল হাঁড়ি, কলসিতে ভরে পাহাড়ী খাড়াই পথ বেয়ে কাঁধে কিংবা মাথায় করে নিয়ে আসতে হয় বাড়িতে। তবেই মেটে তেষ্টা। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও পরিস্রুত পানীয় জল ‘স্বপ্নই’ থেকে গিয়েছে পুরুলিয়ার আড়ষা ব্লকের হেটগুগুই পঞ্চায়েতের চুলাপানি, হেটবেড়া গ্রামে। একবিন্দু জলের জন্য যেন সিন্ধু হাহাকার!
চুলাপানি, হেটবেড়া পাশাপাশি দু’টি গ্রাম। দুই পাহাড়ী টোলায় মেরেকেটে ২৫ থেকে ৩০টি আদিবাসী পরিবারের কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা, আর জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করে যা দু’পয়সা মেলে, তাই দিয়েই চলে সংসার। তবে, তাঁদের খেয়াল রাখার কেউ নেই! গ্রামে প্রবেশের নেই কোনও রাস্তা। নেই পরিস্রুত পানীয় জলের বন্দোবস্তও। দুই গ্রামের অদূরে রয়েছে একটি পাহাড়ী ঝর্ণা। বর্তমানে অবশ্য ঝর্ণায় জল নেই। তবে, পাহাড়ের গা চুঁইয়ে পাথরের গর্তে যে জল জমে, সেই জল থালায় করে তুলে হাঁড়ি কলসিতে ভর্তি করেন বাসিন্দারা। তারপর প্রায় এক কিলোমিটার পাহাড়ী পথ বেয়ে সেই জল তাঁরা গ্রামে নিয়ে আসেন। এছাড়াও, হেটবেড়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ছোট্ট একটি নদী। সেই নদীর পাশেই দাঁড়ি(ছোট গর্ত)খুঁড়ে রেখেছেন বাসিন্দারা। সেখান থেকেও অনেকে জমা জল সংগ্রহ করেন। খাওয়ার আগে তা কাপড়ে ছেঁকে নিতে হয়। গরম কালে ঝর্ণা কিংবা দাঁড়ির জল শুকিয়ে গেলে কষ্ট আরও বাড়ে।
হেটবেড়ার বাসিন্দা লক্ষ্মীমণি মুর্মু, কাজলী মুর্মু বলছিলেন, ‘একটু জলের জন্য আর কত কষ্ট করব বলত? দেখছিস না হাঁড়ি ভর্তি জল নিয়ে কীরকম খাড়াই পাথুরে পথ বেয়ে উঠতে হয়। পড়ে গেলে তো হাড়গোড় ভাঙবে। একটু জলের ব্যবস্থা করে দিবি?’
গ্রামেরই বাসিন্দা একলু কিস্কু বলেছিলেন, ‘নেতারা গ্রামে এলেই বুঝতে পারি ভোট এসেছে। গ্রামে জলের ব্যবস্থা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু, তারপর সব ভুলে যায়।’
শুধুই কি জল? গ্রামের এখনও রাস্তাটুকুও হয়নি। চারচাকা তো দুরস্ত, বাইকে করে গ্রামে পৌঁছনোও যেন দুঃসাধ্য। গ্রামে ঢোকে না কোনও অ্যাম্বুলেন্স। কারও কোনও বিপদ হলে কিংবা প্রসব যন্ত্রণা হলে ভরসা সেই ডুলি কিংবা খাটিয়া। রোগীকে খাটিয়ায় চাপিয়ে পাহাড়ী পথ পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার নিয়ে যেতে হয়। তারপর সেখান থেকে গাড়ি করে তবেই পৌঁছনো যায় হাসপাতালে। প্রশ্ন উঠছে, স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও কেন এই বঞ্চনা সহ্য করবেন বাসিন্দারা?
পঞ্চায়েতের প্রধান অনসূয়া মাহাত বলেন, ওই এলাকা একেবারে শুষ্ক। মাটি খুঁড়লেই জল পাওয়া যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাও আমরা চেষ্টা করছি। জলের খুব সমস্যা হলে আমরা ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করি। তাঁর সংযোজন, রাস্তার ব্যাপারটাও আমরা দেখছি। পুরুলিয়া সদর মহকুমা শাসক উত্পল ঘোষ বলেন, এই সমস্যার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে সমাধানের সবরকম চেষ্টা করা হবে। -নিজস্ব চিত্র