নিজস্ব প্রতিনিধি, পুরুলিয়া: প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী সুনীল মাহাতর লেখা বহুল প্রচলিত ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন’ গানটি গাইছিলেন মেদিনীপুরের এক শিল্পী। তাঁর গান শেষ হতে না হতেই মঞ্চে উঠে এলেন জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ তথা মানভূম কালচারাল অ্যাকাডেমির সভাপতি হংসেশ্বর মাহাত। হলে উপস্থিত অন্যান্য ঝুমুর শিল্পীদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘এতক্ষণ ধরে যে বাজনাটা বাজল, এটা কি ঝুমুরের বাজনা?’ উত্তর ভেসে এল, ‘না’। হংসেশ্বরবাবু বললেন, ‘আমরা নিজেদের নিজস্বতা ভুলে গিয়ে অন্যদের নকল করছি।’ বাদ্যকাররাও বলে উঠলেন, ‘গায়ক ভালো হলে তবেই তো বাজনা ভালো হবে!’ শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না হংসেশ্বরবাবু। কার্যত শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেই গেয়ে উঠলেন ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন’। হাততালিতে ভরে উঠল গোটা হল।
জেলার তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে বুধবার থেকে পুরুলিয়ার রবীন্দ্রভবনে শুরু হয়েছে ঝুমুর গানের কর্মশালা ও অনুষ্ঠান। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের মোট ১০০জন লোকশিল্পীকে নিয়ে আগামী তিনদিন এই অনুষ্ঠান চলবে। এদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলার তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী, জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ হংসেশ্বর মাহাত, শিবানী মাহাত, জয়মল ভট্টাচার্য, অজিত বাউরি প্রমুখ। সেখানে গান গেয়ে প্রশংসা কুড়ালেন হংসেশ্বরবাবু। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা যতই রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার চেষ্টা করি না কেন, অত সহজে গাইতে পারব না। তেমনই কলকাতার লোকও যতই ঝুমুর গাওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, সঠিকভাবে গাইতে পারবে না। ভুল হবেই। কারণ ঝুমুর পুরোটাই লোকভাষা ও লোকসুরকে কেন্দ্র করে তৈরি। যারা এখানে জন্মেছে, এখানের জল আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছে, তাদের মতো অন্যরা কি পারবে?’
ঝুমুর বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, ‘পিঁদাড়ে পলাশের বন’ গানটি ঝুমুর গান হলেও তা কলকাতার শিল্পীদের হাতে পড়ে বদলে গিয়েছে। তাঁরা নিজেদের মতো করে গেয়েছেন। তাঁদের সুরটাই বহুল প্রচারিত হয়ে গিয়েছে। তাই আজকালকার ‘তথাকথিত’ ঝুমুর শিল্পীরাও সেই সুরেই গান মঞ্চস্থ করছেন। তবে, ওই গানে পাতা নাচ সম্ভব নয়। যদি করা হয়, তা জোর করে করা হবে। জেলার অন্যতম বিশিষ্ট ঝুমুর শিল্পী কিরীটী মাহাত বলছিলেন, ‘ক্রমশই ঝুমুরের বিপর্যয় ঘটছে। আমরা নিজেরাই এর বিপর্যয় ঘটাচ্ছি। অন্যের দেখে নকল করার প্রবণতা এই বিপর্যয়কে আরও বাড়িয়ে তুলছে।’ হংসেশ্বরবাবু বলছিলেন, ‘ঝুমুরের মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তার ফলে ঝুমুরের মূল যে বৈশিষ্ট্য, তা হারিয়ে যাচ্ছে। ঝুমুর গানকে আধুনিকভাবে গেয়ে তাকে ঝুমুর নাম দিয়ে চালানো হচ্ছে। এই বিপর্যয় আটকাতে এই ধরনের কর্মশালা আরও জরুরি।’