• বাড়িতে তিন দেহ, গাড়িতে মৃত্যুর মুখে আরও তিন, খুনের পর আত্মহত্যার চেষ্টা? ‘রহস্যের ঘনঘটা’ কলকাতায়
    বর্তমান | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: সিসি ক্যামেরার ফুটেজে মঙ্গলবার ১২টা ৫৩। ট্যাংরার শীল লেনের দে বাড়ির গ্যারাজ থেকে বেরিয়ে এল গাড়ি। চালকের আসনে ছোটভাই প্রসূন। পাশে নাবালক ভাইপো। আর পিছনের সিটে বড়ভাই প্রণয় দে। 


    বুধবার ভোর। বাইপাসের রুবি মোড় ও কালীকাপুরের মাঝামাঝি মেট্রোর পিলারে সজোরে ধাক্কা মেরে পড়ে আছে গাড়িটা। বনেট বলে কিছু নেই। ফেটে গিয়েছে এয়ার ব্যাগ। তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হল তাদের কাছের হাসপাতালে। তারপরই সাদা চোখে দেখা ‘দুর্ঘটনা’ এক ঝটকায় হদিশ দিল তিনটি মর্মান্তিক রহস্যমৃত্যুর। পুলিস ছুটল ট্যাংরায়। শীল লেনের চারতলা বাড়ি। দরজা ভেঙে ঢুকে দেখল, দোতলার তিনটি ঘরে পড়ে রয়েছে তিনটি দেহ। বড়বউ সুদেষ্ণা দে, ছোটবউ রোমি দে, আর তাঁর মেয়ে প্রিয়ংবদা। তাহলে কি খুন করে নাবালককে নিয়ে দুই ভাই আত্মহত্যার চেষ্টায় বেরিয়ে পড়েছিলেন? কেনই বা এমন নৃশংস পথ বেছে নিলেন? রহস্য বাড়ছে! সেটাই ভেদ করার চেষ্টায় পুলিস। রোমির বাপের বাড়ির অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের মামলা শুরু হয়েছে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু অজ্ঞাতপরিচয় কেন? রহস্য আরও ঘনীভূত।  


    গরফা থানা এলাকা থেকে শুরু হওয়া একটি ঘটনা ট্যাংরা থানা এলাকার সঙ্গে এভাবে জুড়ে যাবে, তা ভাবতেও পারেনি এই শহর। প্রসূনের স্ত্রী রোমির হাতের শিরা কাটা। গলায় বাঁদিক থেকে ডানদিক পর্যন্ত কাটার চিহ্ন স্পষ্ট। মেয়ে প্রিয়ংবদার মুখ থেকে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে। প্রণয়ের স্ত্রী সুদেষ্ণারও হাতের শিরা কাটা। তিনতলায় উঠে মিলল রক্তমাখা একটা ছুরি। ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেন কলকাতা পুলিসের কমিশনার মনোজ ভার্মা সহ একাধিক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। পুলিস জানাল, পায়েসের মধ্যে ওষুধ মিশিয়ে তাঁরা সকলেই খেয়েছিলেন। তাতেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন সবাই। ওই অবস্থাতেই কিশোরী প্রিয়ংবদার গলা টিপে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে বলে অনুমান। গাড়ি দুর্ঘটনার পর আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে, সেখানকার নথিতেও ‘ড্রাগ ওভারডোজে’র উল্লেখ রয়েছে। তাহলে বউদের হাতে আঘাত করল কে? নাবালক ছেলেটিকেই বা কেন সঙ্গে নিয়ে বেরনো হল? তাহলে কি বাড়ির তিন মহিলাকে খুন করে পুরুষরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন? কিন্তু কেন? প্রশ্ন অনেক। সিপি বলেছেন, সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে পুলিস সূত্রে খবর, মঙ্গলবার রাতে পরিবারের সকলে মিলে ছাদে উঠেছিলেন। তবে কি পরিবারের সবাই মিলে আত্মহত্যা করাই ছিল লক্ষ্য? তা অসফল হওয়ার পরেই কি নতুন পরিকল্পনা? প্রাথমিক তদন্তে পুলিসের অনুমান, গোটা ঘটনার পিছনে ব্যবসায়িক লোকসান। বাবার শুরু করা চামড়ার ব্যবসা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দুই ছেলে। ট্যাংরায় চারতলা বাড়ির অদূরেই রয়েছে দে পরিবারের ফ্যাক্টরি। স্থানীয়দের বক্তব্য, ঝাঁ-চকচকে ফ্যাক্টরিতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে শ’পাঁচেক লোক যুক্ত। কিন্তু ভালো চলছিল না ব্যবসা। প্রতিদিনই ট্যাংরার বাড়িতে পাওনাদাররা এসে ভিড় করতেন। মনোজকুমার গুপ্তা নামে এক ব্যবসায়ী ৯৯ লক্ষ টাকার মাল সাপ্লাই দিয়েছিলেন ফ্যাক্টরিতে। তাঁর দাবি, ২৩ লক্ষ টাকা পাওনা ছিল তাঁর। শুক্রবার চেক দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সেই চেক বাউন্স করে। মনোজবাবুর বক্তব্য, আমাকে বলা হয়েছিল টাকা আসেনি বলে সমস্যা হয়েছে। সোমবার জমা দেবেন। কিন্তু মঙ্গলবার সেই চেকও বাউন্স করে। সেদিন বিকেলেই দে বাড়িতে যান মনোজ। কিন্তু কাউকে পাননি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অনেক ডাকাডাকি করেন তিনি। তারপর খবরের কাগজের উপর লিখে যান, যোগাযোগ করবেন। প্রসূনের এক সম্পর্কিত ভাইপোর কাছেও যান মনোজ। ভাইপো ফ্যাক্টরি দেখাশোনা করেন। তিনিও বলেন, ৩৫ থেকে ৪০ বার ফোন করেছি। কেউ ফোন ধরেনি। আরও এক ব্যবসায়ী শ্যামলাল জানান, আমাকেও ৮০-৯০ লক্ষ টাকার চেক দিয়েছিল। সব বাউন্স করেছে।
  • Link to this news (বর্তমান)