দুই দেশের আবেগ মাখা পরম্পরায় এমন ছন্দপতন ঘটবে, তা ভাবেননি কেউই। এক বছর আগেও ঢাকায় একুশের ঐতিহাসিক শহিদবেদিতে সেন্ট জ়েভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দেখা গিয়েছিল। ছিলেন দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও। এ বছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক টানাপড়েনের আবহে সেই অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত বাতিলই করতে হয়েছে।
২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ থেকেই শুরু হয়েছিল সেন্ট জ়েভিয়ার্সের ওই অনুষ্ঠান। সে-বছরই সেন্ট জ়েভিয়ার্সে বাংলা অনার্সের পাঠ্যক্রম চালু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভাষা শহিদবেদিতে একুশের দিন দশেক আগের অনুষ্ঠানে জ্বালা মশাল বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘোরানো হয়। সেই পরম্পরা বছর-বছর চলছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাঘবপুর, শিলিগুড়ি এবং নিউ টাউনে সেন্ট জ়েভিয়ার্সের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গন ঘুরে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকালে মূল অনুষ্ঠান হত পার্ক স্ট্রিটের সেন্ট জ়েভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বছর নিচু তারে অনুষ্ঠান হলেও বাংলাদেশের উত্তাপ মাখা মশালটি দেখা যাবে না।
সেন্ট জ়েভিয়ার্সের প্রাক্তনীদের সংগঠনের সাম্মানিক সম্পাদক তথা চলচ্চিত্র প্রযোজক ফিরদৌসুল হাসান বলছিলেন, “নানা রাজনৈতিক টানাপড়েনের জন্যই এ বছর ঢাকা থেকে মশালযাত্রা বা মশাল কলকাতায় আনা বন্ধই রাখছি। সব ঠিক থাকলে পরের বার নিশ্চয়ই এ অনুষ্ঠান করা যাবে।” শুধু ঢাকা বা সেন্ট জ়েভিয়ার্সের উপাচার্যই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঢাকার অনুষ্ঠানে থাকতেন। বাংলাদেশে সেন্ট জ়েভিয়ার্সের অনেক প্রাক্তনীও থাকতেন। হাসানের কথায়, “ঢাকায় প্রজ্জ্বলিত মশালটি চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজ বা বেঙ্গালুরুর সেন্ট জোসেফেও আমরা নিয়ে গিয়েছি। একুশের ইতিহাস এবং ভারতের বহুভাষিকতা, দুটো উদ্যাপনই মিশত আমাদের অনুষ্ঠানে।”
বাংলাদেশে নানা পট পরিবর্তনের আবহে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্যের সুরটি যে খানিক ধাক্কা খেয়েছে, তা একুশের আবহেও মালুম হচ্ছে। কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনের একুশের অনুষ্ঠানটি এ বার কার্যত রুদ্ধদ্বার কক্ষে নিজেদের নিয়েই সারা হচ্ছে। সূত্রের খবর, বিতর্ক এড়াতেই এই সিদ্ধান্ত। কলকাতায় একুশের নানা অনুষ্ঠানে এখানে কর্তব্যরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের ডাক পড়ে সাধারণত। এ বার দু’দিকেই তা নিয়ে দ্বিধা আছে।
কলকাতাতেও শিক্ষক এবং অধ্যাপকমহলের একাংশে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এ রাজ্যের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের বড় অংশ অবশ্য তা নিছকই ‘বোকামি’ বলে নস্যাৎ করছেন। তাঁরা মনে করাচ্ছেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে খ্যাত একুশে ফেব্রুয়ারির ব্যাপ্তি বিশ্বজনীন এবং তা ভারতের বহুভাষিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই।
দেশপ্রিয় পার্কে যথারীতি হচ্ছে একুশের সরকারি অনুষ্ঠান। যাদবপুর এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাঙ্গনে নানা ভাবে একুশে উদ্যাপন হচ্ছে। সদ্য প্রয়াত প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ছায়া এ বার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠানে। বাংলার অধ্যাপক রাজ্যেশ্বর সিংহ জানান, টোকিয়ো ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ়ের সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি পড়তে আসা জাপানি ছাত্রছাত্রীরা ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গেয়ে শোনাবেন। নিজেদের ভাষার গানও তাঁরা গাইবেন।