• সরে গিয়েছে ‘হেডলাইট’, বাংলায় অভিষেক-শুভেন্দু দ্বৈরথ আপাতত অতীত, ফের যুযুধান মমতা-শুভেন্দু
    আনন্দবাজার | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পিচে বল পড়ে গিয়েছে বুধবার। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে নামছে ভারত। কাকতালীয়, কিন্তু বঙ্গ রাজনীতির উইকেটে আপাতত ‘ফরওয়ার্ড শর্ট লেগ’ থেকে ‘ডিপ ফাইন লেগে’ সরে গিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সুবাদে আবার সরাসরি যুযুধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারী। যার সাক্ষী রইল মঙ্গলবারের বিধানসভার ভিতর এবং বাহির। ২০২১ সালের ভোটের কয়েক মাস পর থেকে মমতা খুব একটা শুভেন্দুর কথার প্রতিক্রিয়া দিতেন না। বদলে শুভেন্দুকে ‘জবাব’ দিতেন অভিষেক।

    ক্রিকেটের পরিভাষায় ‘ফরওয়ার্ড শর্ট লেগ’ বা সিলি পয়েন্ট’-এর মতো ফিল্ডিং পজ়িশনকে অনেকে ‘হেডলাইট’ বলে থাকেন। নতুন ব্যাটার এলে ‘হেডলাইট’ দেওয়া মানে তাঁর ঘাড়ের কাছে দুই ফিল্ডার লাগিয়ে দেওয়া। যাতে ব্যাট-প্যাড ক্যাচ উঠলে সেটা তারা লুফতে পারে। একই সঙ্গে কয়েক ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ব্যাটারের উপর মানসিক চাপ তৈরি করে। সঙ্গে বাছা বাছা ‘স্লেজ়িং’।

    ২০২১ সালে বিরোধী দলনেতা হিসাবে শুভেন্দু যখন উইকেটে আসেন, অভিষেক তখন থেকেই ‘হেডলাইট’-এর ভূমিকায়। শুভেন্দু যা বলেছেন বা করেছেন, তার কঠোর থেকে কঠোরতর প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন অভিষেক। মমতা তখন শুভেন্দুকে উপেক্ষাই করেছেন। এক বার বিরোধী দলনেতার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী তো এমনও বলেছিলেন যে, ‘‘ওঁর ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া নিতে গেলে আমার ব্লক সভাপতিদের জিজ্ঞাসা করবেন!’’ সেই মমতাই বাজেট অধিবেশনে রাজ্যপালের ভাষণের উপর ধন্যবাদজ্ঞাপক বক্তৃতা করতে গিয়ে শুভেন্দুর তোলা বিবিধ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। মমতা বিধানসভায় মঙ্গলবার বলেছেন ৮২ মিনিট। যার ৭০ শতাংশ জুড়েই ছিল শুভেন্দুর সোমবারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া। তৃণমূলের একাংশ মনে করছে, এর ফলে শুভেন্দুকে ‘বাড়তি গুরুত্ব’ দিয়ে ফেলেছেন মমতা। অন্য অংশের বক্তব্য, মমতা দেননি। শুভেন্দু স্রেফ ঘটনাচক্রে সেই গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছেন। কালীঘাট-ঘনিষ্ঠ এক নেতার বক্তব্য, ‘‘দিদি ওই জঙ্গি-যোগের কথাটা নিতে পারেননি। শুভেন্দুকে তুলোধনা করার সেটাই কারণ।’’ অনেকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অভিষেক দূরে থাকার সুবাদে শুভেন্দুকে সে ভাবে তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছিল না। মমতা বুঝিয়েছেন, বিরোধী দলনেতা একতরফা আক্রমণ করার জায়গা আর পাবেন না। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘শুভেন্দু ফাঁকা মাঠ পেয়ে গিয়েছিলেন। দিদি সেখানে ব্লকার হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন।’’ কিন্তু এটা কেউই অস্বীকার করছেন না যে, ‘গুরুত্ব’ পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন শুভেন্দু। যেমন এ-ও মেনে নিচ্ছেন যে, ময়দানে অভিষেক থাকলে খেলাটা এমন হত না। শুভেন্দুর ঘাড়ের কাছে ‘হেডলাইট’ রেখে মমতা তখন অনেক খোলামনে বল ডেলিভারি করতে পারতেন।

    গত কয়েক মাস ধরে সাংগঠনিক কাজে অভিষেক খানিক ‘নিষ্প্রভ’। তাঁর একমাত্র ব্যস্ততা নিজের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের ‘সেবাশ্রয়’ প্রকল্প নিয়ে। ক্রিকেটীয় পরিভাষায়, ‘হেডলাইট’ সরে গিয়েছে ‘ডিপ ফাইন লেগে’।

    গত সোমবার শুভেন্দু অভিযোগ করেছিলেন, মমতার সঙ্গে কাশ্মীরি জঙ্গিদের যোগাযোগ রয়েছে। মমতা বিধানসভায় বলেন, তিনি এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখবেন। অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে এক মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ছেড়ে দেবেন! ঘটনাচক্রে, মমতার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখার কথা শুনেই শুভেন্দু বলেন, তিনি কেন্দ্রীয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি লিখবেন। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ‘হুমকি’ দিয়েছেন। অর্থাৎ, টক্কর সমানে-সমানে।

    যখন অভিষেকের সঙ্গে ‘টক্কর’ চলত শুভেন্দুর, তখন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদের নাম না নিয়ে তিনি অভিষেককে ‘ভাইপো’, ‘কয়লা ভাইপো’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতেন। একটা সময়ে কয়লা মামলায় ফেরার বিনয় মিশ্রের নাম নিয়েও অভিষেককে বিঁধতেন শুভেন্দু। পাল্টা অভিষেক বলেছিলেন, বিনয়ের সঙ্গে বিরোধী দলনেতার কথোপকথনের অডিয়ো ক্লিপ তাঁর কাছে রয়েছে। সময় মতো বার করে দেবেন। লক্ষণীয়, সমাপতন হলেও তার পর থেকে বিনয়ের নাম খুব একটা মুখে আনেন না শুভেন্দু। অনেকের এমনও বক্তব্য, গত কয়েক মাস ধরেই অভিষেক সম্পর্কে শুভেন্দু খুব ‘আক্রমণাত্মক’ নন। অনতি অতীতে তেমন উদাহরণ রয়েছে বলে দুই শিবিরের কেউই মনে করতে পারছেন না। তবে পাশাপাশিই তাঁরা বলছেন, অভিষেক ‘সেবাশ্রয়’ ছাড়া তেমন কোনও বিষয়েই মাথা ঘামাচ্ছেন না। তাঁকে ঘিরে নতুন করে কোনও ‘বিষয়’ তৈরি হয়নি যে, শুভেন্দু তাঁকে রাজনৈতিক আক্রমণ করবেন।

    তবে মমতা-শুভেন্দু আবার যুযুধান হওয়ার আরও একটি ব্যাখ্যা তৈরি হয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। যা শাসক শিবিরের বর্তমান সমীকরণের নিরিখে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। যে ব্যাখ্যা বলছে, গত কয়েক মাসে মমতা একাধিক বার বার্তা দিয়েছেন, তৃণমূলে তিনিই ‘শেষ কথা’। লোকসভা এবং রাজ্যসভার সংসদীয় দল কোন পথে চলবে, তা-ও যে তিনিই নির্ধারণ করবেন, সেটিও মনে করিয়ে দিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘আমিই চেয়ারপার্সন।’’ অর্থাৎ, দলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তাঁর হাতে। আর সরকার তো তাঁর হাতেই। এ বার বিরোধী দলনেতাকে জবাব দেওয়ার পরিসরও নিয়ে নিলেন তিনি।

    ব্যাখ্যা অনেক। প্রেক্ষাপটও নানাবিধ। কিন্তু নির্যাস একটিই— ‘হেডলাইট’ দূরে সরতেই বঙ্গ রাজনীতিতে ফের যুযুধান মমতা-শুভেন্দু।

  • Link to this news (আনন্দবাজার)