সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
কথায় আছে, কথা একবার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। কিন্তু সে কথা শুনছে কে! আর যদিও বা কেউ শোনে, সেই তালিকা থেকে নির্ঘাৎ বাদ পড়বে রাজনীতির কারবারিরা।
খড়্গপুরের এক রসিকজনের মন্তব্য, ‘ইচ্ছে করলে অনেক কিছু না-শুনেও থাকা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চললেও তাঁদের ভাষণ থেকে কান বাঁচানোর কারও সাধ্যি আছে নাকি!’
তা কথাটা নেহাত কথার কথা নয়। ‘বিরাট জনসভা’, ‘মাঝারি কর্মিসভা’ কিংবা ‘সেজ-মেজ পথসভায়’ গর্জে ওঠে মাইক। সে মাইকে কাদের গর্জন শোনা যায়? কার আবার, অমায়িক নেতা কিংবা নেত্রীর! আর সে কথায় কী থাকে?
সেই রসিকজন ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘কী থাকে না, সেটা বলাই বরং সহজ। ‘ক’ কোতল করতে চাইছেন ‘খ’-কে। ‘খ’-ও ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নন। তিনিও খাপ খুলছেন। ‘গ’ গর্জে উঠছেন ‘ঘ’-এর বিরুদ্ধে। ‘ঘ’ দিচ্ছেন ঘেরাওয়ের হুমকি। বাংলা বর্ণমালার ৫২টি বর্ণকে নিয়ে একেবারে ছিনিমিনি খেলে চলেছেন এ বঙ্গের নেতা-নেত্রীরা। এই একটিমাত্র বিষয়ে ডান, বাম, রাম— সব একেবারে একসূত্রে বাঁধা!’
তা হঠাৎ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রাজনীতির কারবারিদের ‘অমৃত’ বচন কিংবা ‘মধুর’ ভাষণ নিয়ে এত চর্চা কেন? সহজ উত্তর— ভাষা দূষণের ক্ষেত্রে এ দেশের মহান নেতা-নেত্রীদের একাংশের অবদান যে অনস্বীকার্য!
রাজনীতির আঙিনায় ভাষা দূষণের সূচনা কিন্তু বেশ পুরোনো। সে সব ভাষণের বেশিরভাগটাই ছাপার অযোগ্য। তবে সে কাল হোক বা এ কাল— পাবলিক কিন্তু সব মনে রেখেছে! ভাষা দিবসের আবহে যা নিয়ে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সরব হয়েছেন রাজনীতির লোকজনও।
খড়্গপুরের তৃণমূল নেত্রী হেমা চৌবে যেমন বলছেন, ‘মার্জিত ভাষা কিংবা আদর্শের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, এখন রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ব্যক্তিগত আক্রমণও চলছে। রেয়াত করছেন না নিজের দলের লোকজনও। আমি সিপিআই নেতা নারায়ণ চৌবে, কংগ্রেস নেতা জ্ঞান সিংহ সোহন পালের বক্তব্য শুনেছি। মঞ্চে একে অপরের বিরুদ্ধে মার্জিত ভাষায় আদর্শের বিভেদটুকুই তুলে ধরছেন। আবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দু’জনে একসঙ্গে চা-ও খাচ্ছেন। এ সব এখন অতীত।’
কংগ্রেস নেতা শম্ভু চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, ‘বক্তব্য রাখতে হলে বিষয়ের উপরে গভীর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এখনকার ক'জন নেতা-নেত্রীদের মধ্যে তা আছে!’
বিজেপি নেতা অরূপ দাসের কথায়, ‘কে কত কদর্য ভাষা ব্যবহার করবে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। সবাই ভাবছেন, হাততালি পড়ছে যখন, তখন সব ঠিকই আছে। কিন্তু আসলে কিছুই ঠিক নেই।’
পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিএম নেতা ঝড়েশ্বর বেরার কথায়, ‘এখনকার রাজনীতিতে যে সব নেতা-নেত্রীরা উঠে এসেছেন তাঁদের সম্পর্কে সকলেই খুব ভালো করে জানেন। সেই কারণে ভাষাও সঙ্কটে পড়েছে।’
আর ‘আম আদমি’ কী বলছেন? খড়্গপুরের এক মহিলার বক্তব্য, ‘রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ হলে আজকাল ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সে দিক দিয়ে যেতে ভয় পাই। মঞ্চ থেকে কেউ বেফাঁস কিছু বলে ফেললে কী অস্বস্তিতে পড়তে হবে, বলুন তো!’ মেদিনীপুর শহরের হবিবপুর সরস্বতী বিদ্যামন্দিরের শিক্ষক ও কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কথায়, ‘ভাষা দিবস শুধু পালন করলেই হবে না। মাতৃভাষাকে মায়ের মতোই সম্মান করতে হবে। ভালোবেসে লালন করতে হবে। সেই সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তর চর্চা।’
কিন্তু ওই, সে কথা শুনছে কে? আজ, ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে নানা সাংস্কৃতিক মঞ্চে সপারিষদ উপস্থিত থাকবেন নেতা-নেত্রীরাও। ফের মাইক, ফের ভাষণ, ফের গলার স্বরের ওঠাপড়া। এবং ফের সেই ‘ছুটলে কথা থামায় কে!’ অতএব, সাধু সাবধান!