এই সময়: রীতিমতো পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে ট্যাংরার দুই গৃহবধূ ও এক নাবালিকাকে — ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘটনার কথা সামনে আসার পরে পুলিশের তদন্তে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। আর সেই পরিকল্পনা করা হয়েছে তারও সাতদিন আগে। দুই নাবালককে বাইরে রেখে দুই ভাই ও দুই বউ নিজেদের ‘শেষ’ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
পুলিশের দাবি, কয়েক কোটি টাকা ধার হয়ে গিয়েছিল তাঁদের। সেটা শোধ করতে–না পারার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। তার জন্য দুই ভাই বিভিন্ন ওষুধের দোকান ঘুরে প্রচুর পরিমাণ ঘুম ও প্রেশারের ওষুধ সংগ্রহ করেছিলেন।
তদন্তকারীদের দাবি, দে পরিবারের দুই ভাই প্রণয় ও প্রসূনের বয়ান অনুযায়ী, ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে দেওয়া সেই ঘুম ও প্রেশারের ওষুধ মিশিয়ে বানানো লস্যি (মতান্তরে পায়েস) খেয়ে পরিবারের নাবালিকা সদস্য প্রিয়ম্বদা মারা গেলেও বাড়ির দুই বউ সুদেষ্ণা ও রোমির উপরে তা পুরোপুরি কাজ করেনি। তাঁরা অচৈতন্য হয়ে যান। তাই, ১৮ তারিখ সকালে ওই দু’জনকে খুন করা হয়।
অভিযোগের আঙুল প্রণয় ও প্রসূনের দিকেই। তবে এই কাজে বাইরের কারও সাহায্য নেওয়া হয়েছিল কিনা, তা জানার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। ওই দিনই গভীর রাতে বাইপাসে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হন দুই ভাই এবং বড় ভাই প্রণয়ের ছেলে প্রতীপ। পুলিশকে তাঁরা জানিয়েছেন, আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে ইচ্ছে করেই দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছিল।
ওই তিনজনই এখন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালের একটি সূত্র শুক্রবার জানিয়েছে, এই তিনজনের শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী, তাঁদের সাধারণ কেবিনে দেওয়া যায়। তবে, নিরাপত্তার খাতিরে তাঁরা এখনও আইসিসিইউ–তে রয়েছেন। পুলিশের একাংশের দাবি, সুস্থ হওয়ার মাঝেই খুনের অভিযোগে দুই ভাই প্রণয় ও প্রসূনকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
ইতিমধ্যেই হাসপাতালে গিয়ে তদন্তকারীরা দুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার ভিত্তিতেই পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, সপরিবারে আত্মহত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল ১০ ফ্রেব্রুয়ারি নাগাদ। বাজারে থাকা তাঁদের প্রায় ১০ কোটি টাকার ঋণ শোধ করা সম্ভব নয় বুঝে প্রণয়ই ছোট ভাইকে ডেকে সপরিবারে আত্মঘাতী হওয়ার কথা বলেন। প্রণয়ের স্ত্রী সুদেষ্ণা ও প্রসূনের স্ত্রী রোমি তখন এই সিদ্ধান্তের কথা জানতেন না। ১২ তারিখ তাঁদের পরিকল্পনার কথা বলা হয়। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, সপরিবারে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে সহমত হন দুই বউ। তবে তাঁদের ছেলেমেয়েরা কিছুই জানত না।
তদন্তকারীদের দাবি, ঠিক হয়েছিল ঘুম ও প্রেশারের ওষুধ খেয়ে একসঙ্গে ছ’জন আত্মঘাতী হবেন। সেই পরিকল্পনা থেকেই ১৩ তারিখ থেকে বিভিন্ন ওষুধের দোকান ঘুরে দুই ভাই ঘুম ও প্রেশারের ওষুধ কিনতে শুরু করেন। সাধারণত, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি হয় না। এমনকী, প্রেসক্রিপশন থাকলেও একসঙ্গে বেশি ওষুধ দেওয়া হয় না। দুই ভাই বিভিন্ন দোকান ঘুরে অনেক ওষুধ কিনে ১৭ ফেব্রুয়ারি সেগুলি ওষুধের পাতা বা স্ট্রিপ থেকে বের করেন। তারপরে স্ট্রিপগুলোকে পুড়িয়ে ফেলেন বা নষ্ট করে দেন। প্রমাণ লোপাট করতেই এটা করা হয়েছিল বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন।
পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ১৭ ফেব্রুয়ারি সেই ওষুধগুলো দুধের সঙ্গে মিক্সিতে মিশিয়ে লস্যি বানানো হয়। তবে তাতে মেডিসিনের তীব্র গন্ধ ছিল। তা ছেলেমেয়েরা খাবে না ভেবে তাতে তুলসী পাতা মেশানো হয়। তারপরে তা সকলে খেয়ে শুয়ে পড়েন। ভেবেছিলেন, সকালে কারও ঘুম ভাঙবে না। প্রণয়–সুদেষ্ণা–প্রতীপ এক ঘরে ঘুমোন। প্রসূন–রোমি ছিলেন এক ঘরে। তৃতীয় ঘরে একা ছিল প্রিয়ম্বদা। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে ঝিমঝিমে মাথা নিয়ে প্রথম ঘুম ভাঙে প্রণয়ের। দেখেন স্ত্রী ও ছেলে আচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে। প্রণয় বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে দেখেন বাথরুম থেকে প্রসূন বেরোচ্ছেন। প্রসূনকে জানান, সুদেষ্ণা ও প্রতীপ নিস্তেজ অবস্থায় শুয়ে আছেন। কিন্তু মারা যাননি। প্রসূনও জানান, রোমিও আচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে। কিন্তু প্রিয়ম্বদার মৃত্যু হয়েছে।
তদন্তকারীদের দাবি অনুযায়ী, প্রণয়–প্রসূন ঠিক করেন, তাঁদের স্ত্রীদের হত্যা ছাড়া আর উপায় নেই। প্রিয়ম্বদার সায়েন্সের বক্স থেকে কাগজ কাটার ছুরি নিয়ে সুদেষ্ণা ও রোমি — দু’জনেরই দু’হাতের শিরা কাটার পরে গলাও কাটা হয়। আচ্ছন্ন প্রতীপের হাত কাটতে গেলে সে জেগে গিয়ে চিৎকার করে। পুলিশের দাবি, তখন প্রতীপকে নিয়ে প্রণয়–প্রসূন তিনতলায় যান। সেখানে তাকে সমস্ত ঘটনার কথা জানানো হয়। বলা হয়, রাতে প্রণয় ও প্রসূণ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আত্মহতত্যা করবেন। সূত্রের খবর, সব কথা শুনে প্রতীপ বাবা–কাকার সঙ্গেই রাতে বেরোবে বলে জানায়। এরপরে ১৮ তারিখ রাত পর্যন্ত তাঁরা তিনতলাতেই ছিলেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। দোতলায় পড়েছিল দুই গৃহবধূ ও কিশোরীর দেহ। সে দিনই প্রমাণ লোপাটের জন্য বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরার প্লাগ খুলে ফেলেন দুই ভাই।
তবে প্রিয়ম্বদার মৃত্যু নিয়ে ধন্দে পুলিশ। কারণ, ময়নাতদন্তের রির্পোট অনুসারে, প্রিয়ম্বদার বুক, পা, ঠোঁটে কালশিটে দাগ রয়েছে। মাথার পিছন থেকে সামনে সাইডের দিকে রক্ত জমাট বাধা। অক্সিজেনের অভাবে দু’হাত ও পা নীল হয়ে গিয়েছে। তদন্তকারীরা মনে করছেন ১৮ তারিখ সকালে প্রিয়ম্বদাও আচ্ছন্ন ছিল। তাকে জোর করে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। তা না–হলে, তার শরীরে এতগুলো ইনজুরি মার্ক থাকত না।
১৮ ফ্রেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে গাড়ি নিয়ে বেরোন তিনজন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন প্রসূন। বেলঘরিয়া এক্সপ্রেস হয়ে উলুবেড়িয়ার দিকে যান। সেখানে ট্রাকে ধাক্কা মেরে আত্মহত্যার প্ল্যান করেন। পরে কোনা এক্সপ্রেস, দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজ, এজেসি বোস রোড, সেভেন পয়েন্ট, সায়েন্স সিটি, ইএম বাইপাস হয়ে অভিষিক্তায় পৌঁছন। পুলিশের দাবি, এত রাস্তা ঘুরেও তাঁরা দুর্ঘটনার প্ল্যান কার্যকর করতে পারেননি। শেষে অভিষিক্তার কাছে বাইপাসে মেট্রো রেলের সাত নম্বর পিলারে এসে ধাক্কা মারেন। পুলিশের দাবি, তখন গাড়ির স্পিড নাকি ঘণ্টায় প্রায় ১৩০ কিমি ছিল। দুর্ঘটনার আগে গাড়ির সামনে সিট থেকে প্রতীপকে পিছনে পাঠানো হয়। সামনে আসেন প্রণয়। এরপরে দুই ভাই সিট বেল্ট খুলে দেন।
পুলিশের দাবি, এখনও পর্যন্ত তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখে খুনের ঘটনায় দুই ভাইয়ের যোগই জোরালো হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই দু’জনকেই গ্রেপ্তার করা হবে বলে পুলিশের একাংশের দাবি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে শুক্রবার পুলিশ হাসপাতালে যায়। ট্যাংরার বাড়িতে যান ফরেন্সিক মেডিসিনের টিম ও অটোপসি সার্জেন।
সেখানে কী ভাবে, কোথায় খুন করা হয়েছে তার ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়। দুর্ঘটনাগ্রস্থ গাড়িতে রক্তের দাগ মিলেছে। একটি নীল বোতাম মেলে, তাতেও রক্তের দাগ রয়েছে। ১২টি চাবিযুক্ত একটি রিং মেলে, যা ওই ট্যাংরার বাড়ির বলেই পুলিশ জানিয়েছে। গাড়িটিরও ফরেন্সিক হয়েছে। দেখা গিয়েছে, দুর্ঘটনার পরে গাড়ির গুগল ম্যাপ লক হয়ে গিয়েছিল। তবে গাড়িতে রক্তের দাগ দুর্ঘটনার জন্য, নাকি বাড়িতে খুনের পরে সেই রক্তের দাগ লেগেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।