এই সময়, আলিপুরদুয়ার এবং কলকাতা: জীবনের প্রথম পরীক্ষা শেষের পরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ নতুন কিছু নয়।
মাধ্যমিকের শেষ দিনে পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে পড়ুয়াদের উল্লাস, আবির খেলা কিংবা ব্যাঞ্জো বাজিয়ে নাচানাচির দৃশ্য খুবই পরিচিত। কোথাও কোথাও কড়া গার্ড দেওয়া হলে, সেই স্কুলে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে নানা সময়ে। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষের পরে বই–খাতা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে সেগুলো রাস্তায় উড়িয়ে দিয়ে দেদার সেলিব্রেশন! হ্যাঁ, সেই দৃশ্যই ভাইরাল।
প্রথমে জানা গিয়েছিল আক্রোশের জেরে এই দৃশ্য দেখা গিয়েছে আলিপুরদুয়ারে। তবে দেখা যাচ্ছে, শুধু আলিপুরদুয়ারই নয়, বীরভূম, উত্তর ২৪ পরগনা, মালদা, কলকাতার বাগুইআটি—বিভিন্ন জেলার একাধিক স্কুলের বাইরেই এ ভাবে বই ছিঁড়ে উল্লাস করেছে মাধ্যমিকের একদল পড়ুয়া। এতে অনেকেই হতবাক। প্রশ্ন উঠছে, এ কেমন উল্লাস? যে বই দু’বছর ধরে পড়ে মাধ্যমিক দেওয়া হলো, তার প্রতি ন্যূনতম সম্মান বা ভালোবাসা থাকবে না?
আলিপুরদুয়ারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী অলিভিয়া চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সে বা তার বন্ধুরা এমন ঘটনা ঘটাল কেন? অলিভিয়া জানায়, সে বই ছেঁড়েনি। কিন্তু তার বন্ধুরা মনে করেছে, মাধ্যমিকে বসলেই পাশ করা যায়। তাই এই বই রেখে আর লাভ কী? বারাসতের এক ছাত্র এই ঘটনা ঘটানোর পর কোনও কুণ্ঠা ছাড়াই সরাসরি বলছে, ‘কী হলো বইগুলো রেখে। টুকতেই তো পারলাম না! এত কড়া গার্ড দিয়েছে।’
এই ব্যাখ্যা শুনে তাজ্জব শিক্ষামহলও। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভানেত্রী মমতা রায় এই প্রবণতার নেপথ্যে মূলত তিনটি কারণ খুঁজে বের করেছেন। প্রথমত, যারা এই কাজ করেছে, তাদের সঙ্গে বইগুলোর কোনও সম্পর্কই তৈরি হয়নি। সারাক্ষণই মোবাইলে মত্ত ছিল তারা। আর মাধ্যমিক পাশ করতে এই ছাত্রছাত্রীদের ভরসা বই নয়, প্রাইভেট টিউশনের রেডিমেড নোটস।
দ্বিতীয়ত, ক্লাস নাইন পর্যন্ত পাশ–ফেল ছাড়াই বিনা বাধায় একের পর এক ক্লাসে উঠে গিয়েছে অনেকেই। তাই নাইনের পর পাশ–ফেলের মুখোমুখি হয়ে তারা এতটাই বিরক্ত যে, বইগুলোকে ‘শত্রু’ মনে করছে। বারাসতের ওই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সুরেই মমতা বলছেন, ‘এ বার শুনেছি মাধ্যমিকে কড়া গার্ড দেওয়া হয়েছে। টোকাটুকির বড়সড় ঘটনা ঘটেনি। তাই একাংশ পড়ুয়া ভেবেছে, কী হবে এই বই রেখে, যদি টুকতেই না পারি!’
ফালাকাটা পারঙ্গেরপার শিশুকল্যাণ হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক প্রবীর রায়চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলছেন, ‘অন্য বছরের তুলনায় এই বছর বোর্ডের নির্দেশে আমাদের পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কড়া অবস্থান নিতে হয়েছিল। তাতে পরীক্ষার্থীরা অসদুপায় অবলম্বন করার সুযোগই পায়নি। তবে সেই ক্ষোভ যে এই ভাবে প্রকাশ হতে পারে, ভাবতেই পারছি না।’
কিন্তু মাধ্যমিকে যে ওই পড়ুয়ারা সকলে পাশ করবে, এমন গ্যারান্টি কে দিল? সাধারণ ভাবে মনে করা হয়, এখন মাধ্যমিকে বসলেই পাশ করা যায়। সেটাই কি এই প্রবণতার নেপথ্যে থাকা চালিকাশক্তি? সল্টলেকের বেগম রোকেয়া স্মৃতি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শুভলক্ষ্মী ভকতের তির্যক পর্যবেক্ষণ, ‘বেশির ভাগ পরিবারেই তো একজন করে ছেলেমেয়ে। যা চাইছে, তাই পেয়ে আসছে। ফলে পাশ না করলে অসুবিধে কী, বাবা–মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে নতুন বই কিনে দাও, সেটাই আবার পাবে। তাই বই ছিঁড়তে কোনও বাধা নেই!’
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার একে ‘অতীব নিম্নরুচি’র পরিচয় বলেই মনে করেছেন। তাঁর আক্ষেপ, ‘বই না ছিঁড়ে বরং সেটা ভাই–বোন অথবা গরিব কোনও পড়ুয়াকে দান করে দেওয়ার শিক্ষাটুকুও পরিবারের থেকে পায়নি এরা। কোথায় চলেছি আমরা!’ অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ডাক্তারবাবু এর ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, ‘বইয়ের আর দোষ কোথায়? শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের শেষযাত্রা অনেক কাল আগেই বেরিয়েছে। তাতে খই ছড়ানোর মতো করেই বই ছিঁড়ে ছড়ানো হয়েছে। এতো স্বাভাবিক কথা।’
যদিও মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল এর একটা অন্য দিকও দেখছেন। তিনি মনে করেন, এই সমস্ত আচরণই আসলে চাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। এত বড় পরীক্ষার জন্য বাড়িতে, স্কুলে, কোচিংয়ে যে অসম্ভব চাপের মধ্যে দিয়ে পড়ুয়াদের কাটাতে হয়েছে, পরীক্ষার পর সেই স্ট্রেস রিলিফ করতেই এই পন্থা নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য একাধিক জেলায় স্ট্রেস রিলিফের এই পন্থা কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তার উৎস জানা যায়নি। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ জানিয়েছে, এ দৃশ্য তাদেরও নজরে এসেছে। যে সব জায়গায় এই ঘটনা ঘটেছে, সেখান থেকে ফিডব্যাক নেওয়া হচ্ছে।