ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সমবয়সি জনপদ দমদম পার্ক। এখন ঘোর মহানগর, কিন্তু কয়েক দশক আগেও প্রবীণরা শ্যামবাজারের ও পারে যাওয়ার থাকলে বলে বেরোতেন, “কলকাতায় যাচ্ছি!” এক দিকে যশোর রোড, অন্য দিকে ভিআইপি রোড, মধ্যবর্তী জনপদটি অধুনা অবস্থাপন্ন ফ্ল্যাট-ক্রেতাদের অতি প্রিয়, স্কোয়্যার ফুট-প্রতি দাম শুনলে মধ্যবিত্তের মাথায় ঝিলিমিলি লেগে যায়। পাঁচটি বড় দিঘি, অসংখ্য গাছ, চল্লিশ ফুট চওড়া রাস্তা, খেলার মাঠ, মন্দির, দু’টো হাই স্কুল, বাজার, লাইব্রেরি মিলিয়ে এক ব্যতিক্রমী উপনগর।
এ রকমই অবশ্য চির কাল ছিল না। পূর্ববঙ্গের প্রধানত ফরিদপুর জেলার তৎকালীন মাদারিপুর সাব-ডিভিশন থেকে আগত উদ্বাস্তু কিছু পরিবার যখন মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজার মরিয়া চেষ্টায় দমদমের এই জায়গাটি বেছে নিয়েছিল, তখন তা ছিল এক বিস্তীর্ণ লবণাক্ত জলাভূমি— হোগলা বনে ঢাকা (উপরে বাঁ দিকের ছবি), বিষধর সাপ আর তার চেয়েও মারাত্মক মশার আড়ত। সমবায় সমিতির উদ্যোগে গভীর দিঘি খনন করে, তার থেকে মাটি তুলে, নিচু জলাজমি ভরাট করে তৈরি হল বসত। সে যুদ্ধও সহজ ছিল না। মশার কামড়ে বিরক্ত হয়ে পালিয়ে যেতেন মাটি কাটার শ্রমিকরা, ঠিকাদারের পাওনা মেটানোর মতো টাকা থাকত না সমবায়ের তহবিলে, জমির পুরনো মালিকদের দায়ের করা মামলায় হার হয়েছিল রাজ্য সরকার ও সমবায় সমিতির। এমনও হয়েছে, পুরনো জমিতে মাছ ধরতেন যে মৎস্যজীবীরা, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করেছিলেন তাঁরাও। তবু, সকল কাঁটা ধন্য করে গড়ে উঠল দমদম পার্ক— ১৯৬২’র আগে অবশ্য নাম ছিল কৃষ্ণপুর উদ্বাস্তু কলোনি। পেশাদার নগর পরিকল্পকের সাহায্য নেওয়া কল্পনার অতীত ছিল, তবু কয়েক জন দূরদর্শী উদ্যোগী কী ভাবে সাজিয়েছিলেন গোটা উপনগরটিকে, তার প্রমাণ আজকের দমদম পার্ক (উপরে ডান দিকে সাবওয়ে প্রবেশদ্বার)।
এই উপনগরের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘দেশকাল’-এর পরিকল্পনা ও রূপায়ণে বই— দমদম পার্ক সমবায় উপনগরী: স্মৃতির সরণি বেয়ে পঁচাত্তর বছর (প্রকা: কৃষ্ণপুর রিফিউজি কো-অপারেটিভ কলোনি লিমিটেড)। কী ভাবে গড়ে উঠল এই উপনগর, সেই কাহিনির পাশাপাশি লেখা এলাকার পুরনো ইতিহাসও। সোদপুর থেকে মহিষবাথান অবধি লবণ সত্যাগ্রহের যে পদযাত্রা হয়েছিল, তা গিয়েছিল এই উপনগরের পাশের রাস্তা ধরেই। রয়েছে সেই যাত্রাপথের মানচিত্র (মাঝের ছবি)। বিধাননগর ও দমদম পার্কের মতো উপনগর গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় যে ভাবে হারিয়ে গেল এই অঞ্চলের জলপথ ও তাকে কেন্দ্র করে চলা অর্থনৈতিক জীবন, সেই আভাসও আছে বইটিতে। আজকের আলো-ঝলমল দমদম পার্ককে দেখে যে ছবি আঁচ করার উপায়মাত্র নেই, মাত্র সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগেও যে সেটাই একমাত্র বাস্তব ছিল, এ কথাটি অবশ্য এই উপনগরের জন্য যতখানি সত্য, উন্নয়নের প্রায় সব গল্পের ক্ষেত্রেই ততখানি।
বহুভাষী পণ্ডিত, বৈয়াকরণ, অনুবাদক, সম্পাদক। শিশু-কিশোর সাহিত্য, সঙ্গীত থেকে সরস গদ্যের ভূমিতেও অনায়াস বিচরণ। বাগর্থকৌতুকী তাঁকে জনপ্রিয় করেছিল, করে গেছেন সংস্কৃত সাহিত্য সম্ভার ও কালিদাস সমগ্র-র মতো কাজও। শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে গালিবের কবিতা অনুবাদ করেছেন; লিখেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী। কর্মক্ষেত্র জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনের ছাত্রদের ‘বন্ধুত্ব’ই ছিল ওঁর প্রাণের আরাম। এ বছর জন্মশতবর্ষ জ্যোতিভূষণ চাকীর (ছবি), প্রকাশের মুখে শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ-ও (সম্পা: শুভাশিস চক্রবর্তী, প্রকা: বইওয়ালা বুক ক্যাফে)। সুভাষ মুখোপাধ্যায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অরুণকুমার বসু পবিত্র সরকার প্রমুখের লেখা, সঙ্গে জ্যোতিভূষণের অগ্রন্থিত ছড়া গান প্রবন্ধ বই-আলোচনা, ওঁর গ্রন্থপঞ্জি। আজ বিকেল সাড়ে ৫টায় কলেজ স্ট্রিটে মহাবোধি সোসাইটিতে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ও আলোচনা, জ্যোতিভূষণ-আলেখ্য নিবেদনে ‘অশোকনগর কণ্ঠস্বর’।
সমাজ রাজনীতি শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে নিজেদের ভাবনাকে সংহত, মুদ্রিত রূপ দেওয়ার ভাবনা থেকেই ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু কালধ্বনি পত্রিকার। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে চল্লিশ বছর। চার দশকের যাত্রাকে সমসময়ের সঙ্গে মেলাতে তাদের আয়োজন দু’দিন ব্যাপী বক্তৃতামালা। যাদবপুরে ত্রিগুণা সেন প্রেক্ষাগৃহে গতকাল ও আজ মিলিয়ে একগুচ্ছ আলোচনা— ‘মুনাফা থেকে বিনাশ: নব্য উদার অর্থনীতি, দক্ষিণপন্থী রাজনীতি ও ভারতের অস্তিত্বের সঙ্কট’ নিয়ে। বক্তারা— পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, রণবীর সমাদ্দার, পঙ্কজ সেখসারিয়া ও কবিতা শ্রীবাস্তব। গতকাল ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে ‘ভ্রমরা’ সঙ্গীতগোষ্ঠীর গানও।
রাতের অন্ধকারে মৃত ভাইয়ের কবরে মাটি দিয়ে শাসকের মুখের উপর ‘না’ বলার যে স্পর্ধা আন্তিগোনে দেখিয়েছিল, তা চিরকালীনতার বেড়া পেরিয়ে আবারও সমকালীন হয় সময়ের ভাষ্যে। সোফোক্লেস ও জঁ আনুই-এর লেখা এই নাটক অনুবাদ করেছিলেন চিত্তরঞ্জন ঘোষ। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘সংসৃতি’র নবতম প্রযোজনা অ্যাকাডেমিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধে সাড়ে ৬টায়। নাট্যগোষ্ঠীটির বত্রিশ বর্ষপূর্তির উৎসব আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত; শের আফগান, কোথাকার চরিত্র কোথায় রেখেছ, ব্রেন, খোক্কস, হয়বদন: নানান দিনে। উৎসবের প্রথম দিন রেজিনাল্ড রোজ়-এর টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান বিষ্ণু বসুর অনুবাদে মান্যবর ভুল করছেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট মঞ্চে, ‘টাকি নাট্যম’-এর প্রযোজনা। উদ্বোধনে ব্রাত্য বসু।
বসন্ত-শুরুর কলকাতায় নানান সুরের মেলা। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার গোলপার্কের বিবেকানন্দ হল-এ আজ বিকেল সাড়ে ৫টায় নূপুরছন্দা ঘোষ শোনাবেন অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলালের গান, নিউ আলিপুর সারদা আশ্রম ও ডাইমেনশন ফোর-এর উদ্যোগে। তিন গীত-রচয়িতার ১২৫টি গানের স্বরলিপি-বই প্রকাশ করেছে আনন্দ, বাংলা কাব্যগীতি স্বরলিপি নামে শিল্পীর সেই বইটিরও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হবে। ও দিকে নেতাজিনগর দক্ষিণী সঙ্গীত সম্মিলনীর ৪৩তম বার্ষিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি রোজ সন্ধ্যা ৬টা থেকে, নিরঞ্জন সদনে: কণ্ঠসঙ্গীত ক্ল্যারিয়োনেট সেতার সরোদ বাঁশি তবলায়। ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধে সাড়ে ৬টায় জ্ঞান মঞ্চে লোকসঙ্গীত গাইবেন জয়শঙ্কর, গানজীবনের পঁচিশ পূর্তিতে: প্রাক্কথনে অভীক মজুমদার।
কী ভাবে হল কালীঘাটের পটচিত্রের সূত্রপাত? কারা ছিলেন গোড়ার দিকের চিত্রী— কী রঙে আঁকতেন তাঁরা, কোন কাগজে? চৌকা পট, দীঘল পটের শৈলী ও বিষয়বৈচিত্র কেমন, ইউরোপীয় চিত্ররীতি কালীঘাটের পটচিত্রে প্রভাব ফেলেছিল কি না— আরও কতশত প্রশ্ন জাগে কালীঘাটের পট নিয়ে। এই পটচিত্র হয়ে উঠেছিল সেকালের কলকাতার তথা বঙ্গীয় সমাজের কুকীর্তি-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে শাণিত ব্যঙ্গেরও ধারক-বাহক, সেও আর এক দিক। সুদীর্ঘ গবেষণায় এই দিকগুলি তুলে ধরেছেন অঞ্জন সেন, কালীঘাটের পট: একটি সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গি (প্রকা: ভিরাসাত আর্ট পাবলিকেশন) বইয়ে ধরাও আছে তা। বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচারের আয়োজনে আজ সন্ধ্যা ৬টায় সচিত্র আলোচনা করবেন এই গবেষক-লেখক: ‘কালীঘাট পট: লাইনস অ্যান্ড লিনিয়েজ’। থাকবে পুরাতনী গানের পরিবেশনাও।
গজল গেয়ে পদ্মভূষণ পেয়েছেন, সে পরিচয়ও যেন ম্লান আধুনিক বাংলা গানে তালাত মাহমুদের ভূমিকার পাশে। মোটে চল্লিশের কিছু বেশি বাংলা গান, তা নিয়েই বাঙালি কাটিয়েছে কয়েক দশক। জহুরি অনিল বিশ্বাস যথার্থ ধরেছিলেন, ওঁর গলার ট্রিমেলোই আসল সম্পদ, সুরের উপর দিয়ে কণ্ঠের মিড়াশ্রয়ী শ্লথ গমন। নিউ থিয়েটার্সে ওঁকে আদরের আসন দিয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক। ঘুমের ছায়া, এ যদি সাগর হয়, আধো রাতে যদি, আলোতে ছায়াতে দিনগুলি, রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে-র গায়কের, বাঙালির ‘তপনকুমার’-এর কি বয়স বাড়তে পারে? এ বছর জন্মশতবর্ষ তালাত মাহমুদের, কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি-তে (কেসিসি) আজ সন্ধে ৬টায় প্রকাশ পাবে ওঁর উত্তরসূরি সাহার জ়ামানের বই, তালাত মাহমুদ: এ ডেফিনিটিভ বায়োগ্রাফি। ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শিল্পী।
রবীন্দ্রনাথের গানের যে ক’টি প্রজন্ম ইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত, মঞ্চেও রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনে পরিচিত মুখ, তাঁদের প্রায় সকলের মুখে মুখে ফেরে একটি নাম, মায়া সেন (ছবি)। তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি, স্বরলিপি ও স্বরস্থান সম্পর্কে জ্ঞান অনেক সময় মুদ্রিত স্বরলিপির চেয়েও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণীয় মনে হয়েছে। তাঁর কাছে গান শিখেছেন, এমন অনেকেই তাই অতি সঙ্গত কারণেই উচ্চনাসা। শুধু রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, বালিগঞ্জ প্লেসে ওঁর বাড়িতে শিল্পীদেরও গান শেখার লাইনই লেগে যেত একদা। ‘অনিমেষ আঁখি’, ‘রিমিকি ঝিমিকি ঝরে’, ‘বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী’, ‘আমার যেতে সরে না মন’— রেকর্ডে ধৃত এই সব অবিস্মরণীয় গানের সম্রাজ্ঞী, রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই নির্বিকল্প শিক্ষক ও প্রশিক্ষকের ত্রয়োদশ প্রয়াণদিবস স্মরণে আজ কালীঘাট পার্কের রবীন্দ্রচর্চা ভবনে বিকেল সাড়ে ৫টায় ‘রবিচ্ছায়া’র আয়োজনে স্মরণসন্ধ্যা— প্রবীণ-নবীন শিল্পীদের গান ও আবৃত্তির নিবেদনে।
কলকাতার মজাটা এখানেই, সব সময়েই সে সিনেমা নিয়ে মেতে থাকে। সে ঘরেরই হোক, কি বাইরের। বিশ্বখ্যাত জার্মান পরিচালককে সামনে থেকে দেখে, তাঁর কথা শুনে ও ছবি দেখে উঠতে না উঠতেই, অহো, বেজে গিয়েছে আর এক ফিল্মোৎসবের ঘণ্টা। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ়, নন্দন ও কলকাতাস্থিত ফ্রেঞ্চ কনসুলেট জেনারেল-এর উদ্যোগে ফরাসি ছবির উৎসব আজ থেকে শুরু হচ্ছে— ১ মার্চ পর্যন্ত নন্দনের তিন প্রেক্ষাগৃহে রাজত্ব করবেন জঁ-লুক গোদার ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো আলাঁ রেনে-সহ তাবড় ফরাসি চলচ্চিত্রকাররা। রয়েছে ‘ইন্ডিয়া অ্যাট কান’ বিভাগ, আলাদা নজর পড়েছে ভুটানের সিনেমায়, এই সময়ের ফরাসি কাহিনিচিত্র, অ্যানিমেশন-ছবি ও ছোট ছবিও: সব মিলিয়ে প্রায় আশিটি! আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ়-এর ফেসবুক পেজে রয়েছে দ্বিতীয় বছরের এই উৎসব-সূচি। মহানগরে ছবির বসন্ত এসে গেছে!