এই সময়: ২০২০’র করোনা অতিমারীর আতঙ্ক কি ফিরে আসতে পারে? ফের কি তার ধাক্কায় যেতে পারে বেশ কয়েক কোটি প্রাণ, ফের হতে পারে কয়েকশো কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি, ফের তলানিতে নেমে আসতে পারে তামাম শেয়ারবাজার? ‘অলক্ষণে’ এই সব আশঙ্কার সঠিক উত্তর শুধু সময়ের গর্ভে লুকিয়ে। তবে এই উদ্বেগজনক সম্ভাবনার উদ্রেক হয়েছে সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত সায়েন্স জার্নাল ‘সেল’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে।
যেখানে চিনা গবেষকদলের তরফে দাবি করা হয়েছে, কোভিডের জন্য দায়ী নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্গে গঠনগত এবং কার্যগত ভাবে অনেকটাই মিল থাকা নতুন একটি ভাইরাসের (এইচকেইউ৫-কোভ-২) সন্ধান মিলেছে, যারও প্রাথমিক উৎস বাদুড়। এটিও বাদুড়ের পাশাপাশি মানবকোষের সাহায্যেও সংক্রমিত হতে পারে।
কোভিড-১৯ এর মতোই এই ভাইরাসের ক্ষেত্রেও চিন, বাদুড় এবং ২০১৯-এনকোভ ভাইরাসের ((নভেল করোনাভাইরাস) সঙ্গে কার্যগত মিলের ত্র্যহস্পর্শেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে তামাম দুনিয়া। দুই ভাইরাসের মানবশরীরে কাজকর্মের প্রকৃতি নিয়ে মিল থাকা নিয়ে আমজনতার মধ্যে আগ্রহ নেহাতই থিয়োরিটিক্যাল। আসল ভয় লুকিয়ে উৎসের দেশ—চিন থেকে। যে দেশ প্রথম থেকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের কথা, তার মারণ ক্ষমতার কথা লুকোনোর চেষ্টা করে বিশ্বকে ভুলপথে চালিত করেছিল।
বিশেষজ্ঞমহলের গরিষ্ঠ অংশের দাবি, বেজিং সরকার চার-পাঁচ মাস ধরে দেখছি-দেখব করে সঠিক তথ্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা না করলে, কোভিড-১৯ অতিমারীর আর্থিক এবং অন্য ক্ষতির ব্যাপ্তি অনেকটাই কমানো সম্ভব হতো। এখন এই নতুন ভাইরাসের তথ্য চিনা গবেষকেরা সর্বসমক্ষে আনার পর, সেই ভয়ই ফিরে আসছে আমজনতার মনে, এ বারও কি সংক্রমণের তথ্য লুকোনোর চেষ্টায় ‘ব্যর্থ’ হয়ে ঘুরপথে বিশ্বকে সাবধান করে দিতে চাইছে বেজিং? যে প্রশ্নের উত্তর আপাতত কারও কাছে নেই।
গবেষকদলের প্রকাশিত পেপারে দাবি করা হয়েছে, এইচকেইউ৫-কোভ-২ সংক্রমণের বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর মতো অতিমারীর আকার নেওয়ার ‘ক্ষমতা’ নেই। আগে খোঁজ পাওয়া দুই করোনাভাইরাস ‘সার্স-কোভ-২’ বা ‘মার্স-কোভ’-এর যেখানে মানুষ-থেকে-মানুষে সংক্রমণের প্রবণতা ছিল অত্যন্ত বেশি, সেখানে নতুন খোঁজ পাওয়া এই ভাইরাসটির এখনও সেই স্তরে যাওয়ার (হোস্ট স্যুইচিং) প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়নি। ল্যাবরেটরির কন্ট্রোলড এনভায়রনমেন্টে মানবশরীরে ছড়িয়ে পড়লেও, বাস্তবে কোভিড-এর মতো এতটা মারণ প্রকোপ রাখে না নতুন ভাইরাসটি।
তবে বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রধান চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ঠিক যে ভাবে মানবশরীরে ঢুকত ‘সার্স-কোভ-২’ (করোনাভাইরাস) ঠিক সেই পাথওয়ে (সেল-সারফেস প্রোটিন) ধরে অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম (এসিই২) রিসেপটরের গায়ে নিজেদের ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট’কে আটকে দিয়ে মানবশরীরের অন্দরে প্রবেশ করার ক্ষমতা রয়েছে নতুন এই ভাইরাসের।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এ প্রকাশিত খবরে দাবি করা হয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের উপর যুগান্তকারী কাজ করে ‘ব্যাটওম্যান’ বলে গবেষকমহলে সমধিক পরিচিত শি ঝেংলি’র নেতৃত্বে একদল ভাইরোলজিস্ট, তাঁদের গবেষণায় নতুন এই ভাইরাসের সন্ধান পেয়েছেন। এখানেও মিল হচ্ছে, সেই ‘কুখ্যাত’ উহান ইনস্টিটিউটেই শি কাজ করেন, যেখান থেকে করোনার উৎপত্তি বলে মনে করেন বিশ্বের বহু দেশের বিশেষজ্ঞই।
তবে এখনই বিরাট কিছু আশঙ্কার কিছু নেই বলে দাবি করছেন চিনের বাইরের অনেক বিশেষজ্ঞও। তাঁদের দাবি, এই গবেষণাপত্রটির তথ্য যদি সম্পূর্ণ সত্যিও হয়, তা হলেও বিরাট চিন্তার কিছু নেই এখনই। যেমন পাবলিক হেল্থ স্পেশ্যালিস্ট পর্ণালী ধর চৌধুরীর কথায়, ‘গবেষণাপত্রে যেটুকু তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাতে পুরো বিষয়টিই এখনও ল্যাব সেট-আপে গবেষণা স্তরে রয়েছে, যেটা স্বস্তির বিষয়। এই ভাইরাসের সংক্রমণ এবং মারণ ক্ষমতাও কোভিড-১৯ এর মতোই হবে, ফের অতিমারী পরিস্থিতি ফিরবে, এমনটা বলার মতো সময় এখনও আসেনি। কিন্তু এই ভাইরাসের শরীরে আরও মিউটেশন হয়ে তা যে আরও শক্তিশালী হবে না, এমনটাও হলফ করে বলা যাবে না। ফলে আপাতত অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। তবে পরিস্থিতির উপর একটু নজর রাখতে হবে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি সঠিক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে গবেষণাপত্রে, নাকি আগের বারের মতোই এ বারেও ঘুরিয়ে নাক দেখাচ্ছে চিন?