বাসুদেব ভট্টাচার্য, মেখলিগঞ্জ
‘জানো, জীবনের সবচেয়ে বড় বোঝা কী? বাবার কাঁধে সন্তানের মৃতদেহ। এর থেকে বড় বোঝা আর কিছু নেই।’
এ কে হাঙ্গালের মুখে এই সংলাপ অমর হয়ে গিয়েছে। ছবির নাম ‘শোলে’। এই বোঝা হালকা করা যায় কোন পথে? দেখালেন পরেশ অধিকারী। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও মেখলিগঞ্জের বিধায়ক। তার থেকেও বড় পরিচয়, হীরকজ্যোতি অধিকারীর বাবা।
তরুণ হীরকজ্যোতি পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। কোচবিহারের কুচলিবাড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বছর দু’য়েক আগে একদিন মেখলিগঞ্জ মহকুমা হাসপাতালে আসেন হীরক। দেখেন, এই হাসপাতালের এক্স–রে মেশিন অত্যন্ত পুরোনো। অস্পষ্ট ছবির কারণে রোগী এবং চিকিৎসক, দু’পক্ষেরই অসুবিধা হতো। রোগনির্ণয় করা যেত না ঠিক ভাবে। বাড়ি ফিরে হীরকজ্যোতি বিধায়ক বাবার কাছে আবদার করে বসেন, তাঁর তহবিলের টাকায় যেন একটি ডিজিটাল এক্স–রে মেশিন বসানো হয় মেখলিগঞ্জে। ছেলের কথায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান পরেশ। স্বাস্থ্য দপ্তরে যোগাযোগ করার পরে সম্মতি আসে। তৈরি হয় ডিপিআর। ১৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে আনা হয় এক্স-রে মেশিন। শনিবার তার উদ্বোধন করলেন পরেশ। কিন্তু, বাবার পাশে এ দিন ছেলে ছিলেন না। হীরকজ্যোতি যে আর পৃথিবীতে নেই! মারা গিয়েছেন ২০২৩ সালের শেষে।
এ কথাটা সকলকে জানানোর সময়ে তাই গলা ধরে আসছিল মেখলিগঞ্জের চেয়ারম্যান প্রভাত পাটানির। তিনিই হীরকজ্যোতির উদ্যোগের কথা বলেন। তাঁর ভাষায়, ‘ডাক্তারবাবু এই হাসপাতালে এসে সমস্যাটা ধরতে পেরেছিলেন। তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছেতেই এ সব হয়েছে।’ তরতাজা, প্রতিশ্রুতিমান চিকিৎসক হীরকজ্যোতির প্রয়াণ একেবারে আকস্মিক। দিনটা ছিল ২৩ অক্টোবর। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। সেই সময়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে এই মেখলিগঞ্জ হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে আসা হলেও শরীরে প্রাণ ছিল না। এমন অনেক উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি হিসেবে পরেশকে থাকতে হয়। এ দিনটা ছিল একটু আলাদা।
পরেশ বলেন, ‘রিমন (হীরকজ্যোতির ডাকনাম) আমাকে প্রথম বিষয়টি জানায়, আমিও রাজি হয়ে যাই। আর এটা হলে বহু মানুষ উপকৃত হবেন। তখন তো আর জানতাম না যে, ওর ইচ্ছাপূরণের সময়ে আমাদের মধ্যে থাকবে না।’ এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চান এই হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান পরেশ। খুবই বিহ্বল দেখাচ্ছিল তাঁকে। বলেন, ‘ডিজিটাল এক্স-রে চালু হলো, খুব তাড়াতাড়ি এই হাসপাতালে ব্লাড ব্যাঙ্কও চালু হবে। শেষ বিধানসভার অধিবেশনে মেখলিগঞ্জ মহকুমা হাসপাতালে ব্লাড ব্যাঙ্কের অনুমোদনের জন্য চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের হাতে একটি চিঠি দিয়েছি। আশা করি দ্রুত অনুমোদন দেওয়া হবে।’
এই হাসপাতালে রোজ প্রায় ৮০০ রোগী আসেন। শুধু মেখলিগঞ্জ নন, আসেন পাশের ময়নাগুড়ির মানুষরাও। এক্স রে মেশিন না থাকায় খুবই সমস্যা হচ্ছিল রোগীদের। হাসপাতাল সুপার তাপসকুমার দাসের বক্তব্য, ‘ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন চালু হওয়ায় সুবিধা হলো। বিশেষ করে দুঃস্থ রোগীদের। একটা এক্স-রে বাইরে থেকে করাতে গেলে ৪০০ টাকা লাগে। সেই টাকাটা বেঁচে যাবে, হয়রানিও কমবে।’ রোগীদের দাবিপূরণ হয়েছে। হীরকজ্যোতির ইচ্ছেও। আগামিকাল, সোমবার ছেলের জন্মদিনে নয়া মেশিনে সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়া শুরু হোক। পরেশের ইচ্ছেতে সায় দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।