এই সময়: চার দিন পেরিয়ে গিয়েছে। কেন, কী উদ্দেশ্যে ট্যাংরার দে পরিবার ‘মাস সুইসাইড’-এর পরিকল্পনা করেছিল, তা নিয়ে এখনও ধন্দ কাটেনি। এরই মধ্যে শনিবার রাতে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে জখম তিনজনের মধ্যে পরিবারের বড় ছেলে প্রণয় দে–কে এনআরএস হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
ট্যাংরার রহস্যমৃত্যুর তদন্তে পরতে পরতে উঠে আসছে নানা তথ্য। পুলিশ জানতে পেরেছে, ‘মাস–সুইসাইডের’ জন্য ‘প্ল্যান–এ’ রেডি করা হলেও দে পরিবারের কোনও ‘প্ল্যান–বি’ ছিল না। ফলে, পুরো ঘটনা পরিকল্পনা অনুযায়ী না হওয়ায় পরবর্তীতে তড়িঘড়ি অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যা ঘটনার তদন্তে পুলিশকে সূত্র পেতে সাহায্য করছে।
লালবাজার সূত্রের খবর, স্ত্রীদের সম্মতি নিয়েই প্রণয় এবং তাঁর ভাই প্রসূন গণ আত্মহত্যার পরিকল্পনা করলেও দুই সন্তানকে বিষয়টি জানানো হয়নি। ‘প্ল্যান–এ’ অনুযায়ী, সোমবার রাতে ৬ জন বিষ মেশানো পায়েস খেয়েছিলেন। মঙ্গলবার সকালে দেখা যায় সকলের মৃত্যু হয়নি। এরপর প্রয়োগ করা হয় ‘প্ল্যান–বি’।
সকালে দাদাকে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘোরাঘুরি করতে দেখে পরিস্থিতি সামলাতে স্ত্রী রোমি এবং বৌদি সুদেষ্ণাকে খুনের পরিকল্পনা করেন প্রসূন। মঙ্গলবার দুপুরে পেপার নাইফ দিয়ে তাঁদের শিরা এবং গলা কেটে খুন করেন তিনি। তাতে সঙ্গ দেন দাদাও। তবে, আদৌ তাঁরা সঠিক বয়ান দিচ্ছেন কি না, তা জানতে তিনজনের সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করছে পুলিশ।
বুধবার ভোররাতে ইএম বাইপাসে মেট্রোর পিলারে ধাক্কা মারে প্রণয়দের গাড়ি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভাই প্রসূন এবং প্রণয়ের ছেলে বছর সতেরোর প্রতীপ। দুর্ঘটনার পরে তাঁরা দাবি করেছিলেন, আত্মহত্যা করতে গাড়ি নিয়ে শহরের পথে বেরিয়েছিলেন। এখানেই তদন্তকারীরা ধন্দে রয়েছেন। প্রশ্ন উঠছে, আত্মঘাতী হওয়ার জন্য কেন এ ভাবে মেট্রোর পিলারে ধাক্কা মারতে গেলেন তাঁরা? তার আগে কেনই বা বিমানবন্দর হয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেস–কোনা হয়ে ফের বাইপাসে ফেরত এলেন? মৃত্যু নিশ্চিত করতে অন্য পথও তো খোলা ছিল। ধন্দের দ্বিতীয় কারণ, ওই দিন রাত ১২টার পরে বেরিয়ে ছিলেন তিনজন। কিন্তু, দুর্ঘটনাটি ঘটে তারও ঘণ্টা তিনেক পরে। পুলিশ খতিয়ে দেখতে চাইছে, তবে কি দুর্ঘটনা প্ল্যান ‘বি’–র অংশ? এর পিছনে অন্য কোনও কারণ নেই তো?
শনিবার বাইপাসের বেসরকারি হাসপাতালে যান কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড বিভাগের অফিসারেরা। সূত্রের খবর, সেখান থেকে প্রণয়কে সরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার আগে দু’ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রে খবর, গত চারদিনে অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন তিনজন। পরবর্তীতে খুনের তদন্তে দুই ভাইকে গ্রেপ্তারও করা হতে পারে।
তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখছেন, কেন প্রসূন স্ত্রী এবং বৌদিকে পেপার নাইফ দিয়ে খুন করার দায়িত্ব নিতে গেলেন? প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাচ্ছে, সোমবার রাতে বিষ মেশানো পায়েস খেয়েছিলেন সকলেই। তা জানতেন না প্রতীপ এবং প্রিয়ম্বদা। তাদের এই আত্মহত্যার বিষয়ে জানানো হয়নি। মঙ্গলবার সকালে জ্ঞান ফেরে দুই ভাইয়ের।
তাঁরা দেখেন, আগেই জ্ঞান ফিরে আসায় কান্নাকাটি করছে প্রতীপ। অন্যদিকে, রোমি ও সুদেষ্ণা অচৈতন্য হলেও তাঁরা মারা গিয়েছেন কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না দু’ভাই। ‘প্ল্যান–এ’ ফেল হওয়ায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন দাদা প্রণয়। তা দেখে ‘প্ল্যান–বি’ প্রয়োগ করেন প্রসূন। খুন করেন দুই মহিলাকে।
পুলিশ এটাও জানতে পেরেছে, রোমি এবং সুদেষ্ণাকে আগেই জানানো হয়েছিল, বাজারে যেভাবে ধারের অঙ্ক বেড়ে গিয়েছে তাতে পাওনাদারেরা ঝামেলা করতে পারে। বড় কোনও সমস্যার মুখেও পড়তে হতে পারে সকলকে। এই আশঙ্কার কথা শোনার পরে দুই মহিলাও ‘মাস–সুইসাইডে’ রাজি হয়ে যান।
ইতিমধ্যে ময়নাতদন্তে প্রিয়ম্বদার মৃত্যু বিষ প্রয়োগের কারণে হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার শরীরের নানা জায়গায় যে ভাবে ক্ষত এবং আঁচড়ের দাগ মিলেছে তা থেকে তদন্তকারীদের ধারণা, প্রথমবার বিষ মেশানো খাবারে কাজ না হওয়ায়, দ্বিতীয়বার ফের তাকে পায়েস খাওয়ানো হয়।
প্রতিবেশীদের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাত ১২টা ৫১ মিনিটে প্রতীপকে নিয়ে ট্যাংরার অটল শূর রোডের বাড়ি থেকে বাইরে যাচ্ছেন প্রণয়রা। ময়না তদন্তের রিপোর্টে মৃত্যুর যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে ধরে নেওয়া হচ্ছে, মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যেই তিনজনের মৃত্যু হয়েছিল। প্রণয়ের বয়ানেও তেমনই ইঙ্গিত রয়েছে।
গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন, যদি সকলের মৃত্যু মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে হয়, তা হলে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতীপকে নিয়ে দু’ভাই বাড়ির ভিতরে কী করছিল? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে প্রণয় এবং প্রসূনের সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা করছেন তদন্তকারীরা। ঘটনার পুনর্নির্মাণও করতে চাইছে লালবাজার। এদিকে, বাইপাসের যে বেসরকারি হাসপাতালে তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছিল, কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি না হওয়ায় তাঁদের চিকিৎসার টাকা এখনও দেওয়া হয়নি।