প্রাচীন পুঁথির অমূল্য ভাণ্ডার নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ
বর্তমান | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াপুর: চৈতন্যভূমি নবদ্বীপ একসময় জ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতচর্চার গৌরবময় কেন্দ্র ছিল। সেই ইতিহাসের নীরব সাক্ষী নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সংগ্রহে থাকা প্রাচীন পুঁথিগুলি। প্রায় ৪৫০ বছরের পুরনো পুঁথিও পরিষদের পুঁথিশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। পুঁথিগুলি মূলত পুজো বা দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্র সম্পর্কিত।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, ১৯৯৩ সালে পুরাতত্ত্ব পরিষদ স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই পুঁথি সংগ্রহের কাজ চলছে। এখনও পর্যন্ত আমরা ৯৪টি পুঁথির ক্যাটালগ তৈরি করতে পেরেছি। বাজপেয়ী সরকারের আমলে ‘ন্যাশনাল পুঁথি মিশন’ তৈরি হয়েছিল। ২০০৬-’০৭ সালে ওরাই আমাদের পুঁথিগুলির ক্যাটালগ তৈরি করে দিয়েছিল। তবে আরও অনেক পুঁথি এখনও এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে। প্রকৃত মালিকদের অযত্নেই পুঁথিগুলির এই হাল। সেগুলির পাঠোদ্ধার করে সঠিকভাবে সাজাতে হবে। আমাদের সংগ্রহের বেশিরভাগ পুঁথি বাংলা অক্ষরে সংস্কৃত ভাষায় লেখা। তবে কিছু দেবনাগরী হরফে এবং বাংলা ভাষায় রচিত পুঁথিও রয়েছে। বাংলা ভাষায় রচিত একটি উল্লেখযোগ্য পুঁথি হল শিবচন্দ্রের ‘সত্যপীরের পাঁচালি’। তবে আমাদের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে পুরনো পুঁথি ১৫৭৮ সালের ‘আনন্দ লহরী ব্যাখ্যা’। এটি ন্যায়শাস্ত্রের গ্রন্থ ‘আনন্দ লহরী’-র টীকাগ্রন্থ। পুঁথিশালার অধিকাংশ পুঁথিই নবদ্বীপের বিভিন্ন পণ্ডিত বা পুরোহিত বাড়ি থেকে সংগৃহীত।
এছাড়াও, পুঁথিশালায় রয়েছে পণ্ডিতপ্রবর তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ‘বৃহৎ তন্ত্রসার’-এর মতো দুষ্প্রাপ্য পুঁথিও। তবে আগমবাগীশের নিজের হাতে লেখা পুঁথি এটি নয়। ১৬৪৫ সালে রচিত সেই পুঁথির সন্ধান অজানা। মূল পুঁথির অনুলিপিকরণ করা এই পুঁথিটি ১৮৫২ সালের। ‘বৃহৎ তন্ত্রসার’-এর দু’টি পুঁথির মধ্যে একটি নবদ্বীপ থেকে, আর একটি দুর্গাপুর থেকে পাওয়া গিয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যায় ছ’টি পুঁথি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তার মধ্যে একটি পুঁথি গাছের বাকল নির্মিত, আর একটি তালপাতার। আর তুলোট কাগজের পুঁথি ছিল চারটি। গাছের বাকলের পুঁথির লেখা বন্যার জলে পুরোপুরি মুছে যায়। অন্যদিকে তুলোট কাগজের পুঁথিগুলি ‘ওয়াটার লক’ হয়ে যাওয়ায় আর খোলা সম্ভব হয়নি। শান্তিরঞ্জনবাবু বলেন, বন্যার জলে পলি থাকে। জল শুকিয়ে গিয়ে পুঁথির পাতার মাঝের পলি আঠার মতো আটকে গিয়েছে। তুলোট কাগজের পুঁথিগুলি আমরা স্টেট আর্কাইভস্-এ নিয়ে গিয়েছিলাম। ওয়াটার লক খুলতে প্রয়োজন বিশেষ ধরনের কেমিক্যালের। সেটি ইংল্যান্ড থেকে আনাতে হয়।
রাজ্য সরকারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তার জন্য আবেদন জানাতে হয়। তবে আমরা সেই বিষয়ে চেষ্টা করলেও লাভ কিছুই হয়নি। এক-একটা পুঁথি ঠিক করতে খরচ প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এত টাকা আমাদের ফান্ডে নেই। তবে পুঁথিগুলি সযত্নে রাখা আছে। ভবিষ্যতে টাকা জোগাড় হলে পুঁথির ওয়াটার লক খোলা সম্ভব হবে। তখন আমাদের পুঁথিশালায় আরও চারটি পুঁথি যুক্ত হবে। তিনি বলেন, পুঁথিগুলি সেগুন কাঠের পাটা দিয়ে বেঁধে কিছু কেমিক্যাল ও ন্যাপথলিন দিয়ে লাল শালু মুড়ে রাখা আছে।
দ্বাদশ অর্থ কমিশনের টাকায় তৈরি পরিষদের ভবনটিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন বেশকিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত। ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ছে। শান্তিরঞ্জনবাবুর ক্ষোভ, লিখিতভাবে জানিয়েও কোনও কাজ হয়নি। তবে আমাদের চেষ্টা চলছে। ২০১১ সালের পর থেকে কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারের কাছ থেকেই আর্থিক সাহায্য পাইনি। পুরোটাই চলছে কিছু পরিচিত মানুষের দানের টাকায়। -নিজস্ব চিত্র