শ্যামল সেন, হলদিয়া: ঐতিহ্য, পুরাণ কথা ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে এক দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে মহিষাদলের জগৎপুরের মন্দির। স্থানীয় আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার এবং শিল্পীদের ভাবনা ও হাতের ছোঁয়ায় ওই মন্দির হয়ে উঠেছে প্রাচীন মন্দির শৈলীর নবতম সংস্করণ। সবুজে ঘেরা মনোরম গ্রামীণ পরিবেশে মন্দিরের অসাধারণ শিল্পরূপ ও সৌন্দর্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। হলদিয়া মেচেদা রাজ্য সড়কের দ্বারিবেড়িয়া শিবমন্দির বাসস্টপ থেকে আড়াই কিলোমিটার এগলেই শতাব্দী প্রাচীন ওই মন্দির। জগৎপুরের ঐতিহ্যবাহী রক্ষাকালী পুজো প্রায় ১৭৬ বছরের পুরনো। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে কালীপুজোর টানে লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। কথিত আছে, কলেরা, বসন্ত রোগের মহামারি ঠেকাতে গ্রামের শ্মশানের পাশে অস্থায়ী মন্দির তৈরি করে কালীপুজো শুরু হয়েছিল। করোনা মহামারির সময়ও সেই মন্দিরের রূপ বদলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের আন্তরিক চেষ্টা ও বিন্দুবিন্দু সংগ্রহে অবশেষে গড়ে উঠেছে প্রায় ৮০ ফুট উঁচু বিশাল এক মন্দির। প্রাচীন মন্দির নির্মাণ শৈলী এবং ৫১ সতীপীঠের দেবী মাহাত্ম্য দর্শন, দুই বৈশিষ্ট্য ভক্ত এবং পর্যটকদের নজর কাড়বে, দাবি জগৎপুর মন্দির কমিটির। নবনির্মিত মন্দিরের উদ্বোধন ঘিরে জোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে গ্রামজুড়ে।
মহিষাদলের বেতকুণ্ড গ্রাম পঞ্চায়েতের জগৎপুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গ্রাম হিসেবে বহুদিন থেকেই পরিচিত। কালীপুজোয় সব ধর্মের মানুষের মিলনভূমি হয়ে ওঠে জগৎপুর। মন্দির কমিটি জানিয়েছে, হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। দিল্লির অক্ষরধাম মন্দিরের আদলে তৈরি হয়েছে নতুন এই মন্দির। সেজন্য ‘মিনি অক্ষরধাম’ নামে ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সমসাময়িক জগৎপুরে রক্ষাকালীর পুজো শুরু করেছিলেন গ্রামবাসীরা। সেই ইতিহাস তুলে ধরেছেন ট্রাস্ট ও উৎসব কমিটির সভাপতি প্রবীণ বাসিন্দা ভক্তিপদ পালই। তিনি বলেন, ব্রিটিশদের শোষণ ও অত্যাচারের ফলে গ্রামের আর্থ সামাজিক অবস্থা ভেঙে পড়েছিল। সেই সময় কলেরা মহামারির রূপ নেয়। তৎকালীন জমিদার রমাকান্ত মিশ্রের পুত্র কৈলাস মিশ্র আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মাধ্যমে গ্রামে মহামারির রাশ টানার চেষ্টা করেন। কথিত আছে, শেষমেশ কৈলাসবাবু গ্রামবাসীদের রক্ষা করতে বৈশাখ মাসের সাবিত্রী চতুর্দশী তিথিতে শ্মশানের পাশেই রক্ষাকালীর আরাধনা শুরু করেন। গ্রাম কমিটির সম্পাদক কমলকান্ত অধিকারী বলেন, নতুন মন্দির উদ্বোধনের পর নিত্যপুজো ও ভক্তদের প্রসাদ দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। কালীমূর্তির পাশাপাশি শিব ও দেবী শীতলার মূর্তিও পুজো হবে। একসময় সাবিত্রী চতুর্দশীতে পুজো হতো। বর্তমানে নৃসিংহ চতুর্দশীতে পুজো হয়। আগে তিন দিনের পুজো হতো, এবছর মন্দির উদ্বোধন উপলক্ষে সাতদিনের মেলা ও অনুষ্ঠান হবে। আগামী ২৭ বৈশাখ অর্থাৎ ১১মে নৃসিংহ চতুর্দশীতে মন্দিরের উদ্বোধন হবে। মন্দির কমিটির সদস্য ও সাইট ইনচার্জ রঞ্জন সিংহ বলেন, ইঞ্জিনিয়ার দেবপ্রতিম পট্টনায়ক, শিল্পী মোহনলাল মান্না এবং ভাস্কর শান্তনু মণ্ডলের যৌথ প্রয়াসে মন্দির বাস্তব রূপ পেয়েছে। প্রাচীন শিল্পকলা এবং ৫১ সতীপীঠের দেবী মূর্তিগুলি মন্দিরে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পীরা। মন্দির নির্মাণ কমিটির সম্পাদক কালীপদ সিংহ বলেন, অর্থাভাবে মন্দিরের শেষ পর্যায়ের কাজ থমকে রয়েছে। এই মন্দির নির্মাণে অর্থ দিয়েছেন গ্রামের মহিলারার। মন্দির ঘিরে ভিলেজ ট্যুরিজম সেন্টার গড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন গ্রামবাসীরা। সেজে উঠছে জগৎপুরের মন্দির।-নিজস্ব চিত্র