• পায়েস ‘শুভ’, স্বর্গলাভ হবে, পরিবারকে খুনের ছক জ্যোতিষ প্রণয়ের অঙ্কেই
    বর্তমান | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: দেনার পাহাড় থেকে মুক্তির উপায় নেই। তাই পথ একটাই—মৃত্যু। তবে নিশ্চিত হতে হবে, স্বর্গলাভ যেন হয়। পুজোআচ্চায় বিশ্বাসী দে পরিবারে এই নিদানই দিয়েছিলেন ট্যাংরা কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত বড়ভাই প্রণয়। পুলিসের জেরায় স্বীকার করেছেন, জ্যোতিষচর্চা করেন তিনি। শিখেছেন ‘গুরু’র কাছে। মেনে চলেন বাস্তুশাস্ত্রও। তাই তাঁর লক্ষ্য ছিল—মৃত্যু যেন এমন হয়, যা স্বর্গলাভের পথ খুলে দেবে। তার জন্য তৈরি হবে পায়েস। কেন? পায়েস যে সব ‘শুভ’ অনুষ্ঠানেই প্রয়োজন হয়। জন্ম থেকে ‘মৃত্যু’। ছোটভাই প্রসূনের সঙ্গে মিলে প্ল্যান চূড়ান্ত হয়। প্রথমে দুই বউ, ছেলে-মেয়ে। শেষে তাঁরা নিজেরা। এটাই ছিল পরিকল্পনা। প্রণয়কে পুলিসের জিজ্ঞাসাবাদে নিঃসন্দেহে নয়া মোড় নিল ট্যাংরার ভয়াবহ হত্যারহস্য।


    ট্যাংরার শীল লেনে খুনের ঘটনার তদন্তে নেমে অফিসাররা প্রথমেই জানতে পেরেছিলেন ঘুমের ওষুধ মেশানো পায়েসের কথা। সেটাই খেয়েছিল বাড়ির সকলে। প্ল্যান জেনে ফেলায় জোর করে খাওয়ানো হয়েছিল প্রিয়ংবদাকে। কিন্তু প্রশ্ন ছিল, পায়েসই কেন? ১৭ তারিখ অন্য খাবারও তো রান্না হয়েছিল। তাতে কেন ঘুমের ওষুধ মেশানো হল না? রহস্যটা কোথায়? এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি প্রণয়কে জেরার সময় এই বিষয়টি জানতে চান তাঁরা। দে পরিবারের বড় ছেলে জানান, বাবার আমল থেকেই তাঁরা জ্যোতিষে বিশ্বাসী। তিনি নিজে অ্যাস্ট্রলজি শিখেছেন। বাস্তুশাস্ত্রেও তাঁর দখল রয়েছে। গেটে ঢোকার মুখে স্বস্তিকা চিহ্ন থেকে শুরু করে কোন ঘরের মাপ কী হবে, খাট কোন দিকে রাখা থাকবে, টিভি-ফ্রিজ কোন দিকে বসবে, সবটাই তাঁর পরিকল্পনা মতো করা। বাড়ির সকলের ঠিকুজি-কুষ্ঠিও তাঁর তৈরি। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুযায়ী মাল ডেলিভারি করতেন। এমনকী মাল কিনতেনও দিনক্ষণ মেনে। রীতিমতো ‘গণনা করেই’ গাড়িতে বসত ফ্যান্সি নম্বর প্লেট। তাতেও অবশ্য ঋণের রকেট গতি থামানো যায়নি। দু’হাত ভরে গিয়েছিল আংটিতে। তদন্তকারী অফিসারদের কাছে প্রণয়ের দাবি, জ্যোতিষ বিচার করেই তিনি জেনেছিলেন—ব্যবসায় খারাপ সময় শুরু হচ্ছে। রাশিগত অবস্থানের কারণে তাঁরা ডুবে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কে তাঁর ‘গুরু’? সেই নাম অবশ্য এখনই তদন্তকারীদের কাছে বলতে চাইছেন না অভিযুক্ত প্রণয়। তবে স্বীকার করেছেন, গোটা পরিবারের আত্মহত্যার প্ল্যান চূড়ান্ত হওয়ার পর তিনিই নিদান দিয়েছিলেন, বিষ মেশানো চলবে না। কারণ, তাতে স্বর্গলাভ হবে না। তাই ঘুমের ওষুধ খেতে হবে। বেশি পরিমাণে। তবে যে কোনও খাবারের সঙ্গে মেশানো যাবে না। তাহলে ‘অভীষ্ট লক্ষ্যে’ পৌঁছনো যাবে না। এখান থেকে পায়েসের কথা মাথায় আসে। কারণ, ভোগ হিসেবে পায়েস দেওয়া হয়। ঈশ্বর তা খেয়ে পরম তৃপ্তি লাভ করেন। পায়েস অত্যন্ত শুভ। প্রায় সব শুভ অনুষ্ঠানেই পায়েস রেঁধে পরিবেশন করা হয়। এতে ওষুধ মিশিয়ে খেলে স্বর্গে পৌঁছে যাবেন, এই ভাবনা থেকেই যাবতীয় পরিকল্পনার জন্ম। প্রণয়ের দাবি, দুই গৃহবধুকে খুনের পর জ্যোতিষ মতে কোন দিকে মুখ করে বসলে সঙ্কটমুক্ত থাকা যায়, সেটাও বিচার করেছিলেন তিনি। সেইমতো বসেওছিলেন। এমনকী গাড়িতে কে কোথায় বসবে, সেটাও স্থির করা হয় জ্যোতিষ মতে। জ্যোতিষ মতে বিচার করেই নাকি তাঁর মনে হয়েছিল, পশ্চিম দিকে গিয়ে আত্মহত্যা করলে ভালো। তাই উলুবেড়িয়া রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে লক্ষ্যপূরণ হয়নি। প্রণয়ের নাবালক ছেলে কিন্তু তদন্তকারীদের জানিয়েছেন, গাড়িতে সে বাবা ও কাকাকে বুঝিয়েছিল, আত্মহত্যা কোরো না। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেননি। 
  • Link to this news (বর্তমান)