নিজস্ব প্রতিনিধি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা: গোবুচন্দ্র রাজার রোষ থেকে পৃথিবী রক্ষা পেয়েছিল কীভাবে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় বলে গিয়েছেন, মনে পড়ে? চামার কুলপতি এসে গোবুকে বললেন, ‘নিজের দু’টি চরণ ঢাকো, তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে…।‘ তারপর জুতো তৈরি হল। এবং ‘সেদিন হতে চলিল জুতা পরা…/বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা।’ কবেকার সে কথা এখন উঠছে কেন? কারণ, জুতা আবিষ্কারক সেই চামার কুলপতিও তারপর বহু জুতো বানিয়েছেন, সারিয়েছেন। কিন্তু নিজেকে কোনওদিন ‘ডাক্তার’ বলেননি। অথচ এখন সন্ন্যাসী রুইদাস ‘ডাক্তার’ বলেই নিজের পরিচয় দেন। কেউ ডাক্তার না বললে, খুব রাগ করেন। এবং লোকে যাতে তাঁকে চিকিৎসক হিসেব মর্যাদা দেয়, তার জন্য পোস্টার ছাপিয়ে এলাকা ছয়লাপ করে দিয়েছেন। পেশায় কিন্তু তিনি চিকিৎসক নন।
সন্ন্যাসী রুইদাস ডায়মন্ডহারবারের থাকেন। জুতো সারান। কিন্তু মানুষ তাঁকে ‘মুচি’ বললেই ওঠেন খেপে। বলেন, ‘আমি হলাম গিয়ে জুতোর ডাক্তার।’ যাঁরা তাঁর কথা কানে তোলেন না, তাঁদের সবক শেখানোর জন্য দোকানের সামনে ‘ডাক্তার সন্ন্যাসী রুইদাস, জুতোর ডাক্তার’ বলে পোষ্টার সাঁটিয়ে রেখেছেন। বন্দর শহরের মাঝবয়সি এই মানুষটির কার্যকলাপ নিয়ে সাধারণ মানুষের আলাপ-আগ্রহের শেষ নেই।
এমনিতে রুইদাসরা বংশপরম্পরায় জুতো সারাইয়ের কাজের সঙ্গেই যুক্ত। সন্ন্যাসী পূর্বপুরুষের কাজেই এখন লেগে গিয়েছেন। আর নিয়েছেন ডাক্তার উপাধি। নিজেই পদবির রহস্য উদঘাটন করলেন, ‘মাস খানেক আগে একজন চিকিৎসক জুতো ঠিক করাতে এসেছিলেন। ওঁর পায়ে ছিল সমস্যা। জুতো সেট হচ্ছিল না। আমি ঠিকমতো মাপজোক করে সোল কেটে ওঁর জুতোয় সেট করে দিয়েছিলাম। খুশি হয়ে উনি আমায় বলেছিলেন, আমরা মানুষের জীবন বাঁচাই বলে ডাক্তার। তুমি জুতোর প্রাণ দিয়েছ। তুমিও ডাক্তার।’ ব্যস, এত বছর ধরে যে কাজটি করার কথা মাথায় আসেনি সন্ন্যাসীর, হঠাৎ টনক নড়ার পর সে কাজটিই প্রথমে করলেন। নিজের নামের আগে বড় অক্ষরে লিখে দিলেন ‘ডাক্তার’।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। টাকাপয়সার টানাটানি থাকায় স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। তারপর কিছু কাজ করেছেন। ১০ বছর আগে রুইদাসদের প্রাচীন পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েন। সাইড ইনকাম করেন ঢাকি ভাড়া দিয়ে। তাঁর চেনা একাধিক দল রয়েছে বলে জানালেনও। ডায়মন্ডহারবার ফেরিঘাটের উল্টো দিকে একটি বটগাছের নীচে তাঁর দোকান। সেখানেই জুতো মেরামত করেন। চামড়ার ফুটবলও সারান। যে খদ্দেরদের পায়ে ‘ডিফেক্ট আছে’ তাঁদের সাধারণ জুতো পরতে অসুবিধে হয়। তাঁদের জন্য বিশেষ সোল লাগিয়ে জুতো অসাধারণ করে দেন সন্ন্যাসী। তাঁর বক্তব্য, ‘এ কাজ ডায়মন্ডহারবারের কেউ করে না। তাই সবাইকে এখানেই আসতে হয়।’
এখন ফেরিঘাটে ঢোকার মুখে দেওয়ালজুড়ে শুধুই ‘ডক্টর সন্ন্যাসী রুইদাস’ পোস্টার। পথচলতি মানুষ দেখেন। পড়েন। অবাক হন। হেসে চলে যান। কেউ ছবি তোলেন পরিচিতদের দেখাবেন বলে। কেউ বলেন, ‘দাদা, এতদিন মানুষের ডাক্তার, জন্তুর ডাক্তার শুনেছিলাম। ডায়মন্ডহারবারে তো জুতোর ডাক্তারও মিলছে দেখি! তা সে ডাক্তার ফি কত নেন, জানেন?