রাজদেব শর্মা
সুতন্দ্রা ম্যাডাম বসছিলেন আমার পাশে। পিছনে ছিলেন ম্যাডামের ডান্স ট্রুপের সঙ্গীরা। গল্প করতে করতেই যাচ্ছিলাম। হিসেব করে দেখেছিলাম সময়েই গয়া পৌঁছে যাব। কিন্তু রাস্তায় যে এমন ঘটনা ঘটবে তা ভাবতেও পারিনি। কয়েক ঘণ্টা আগেও গাড়িতে আমার পাশে বসে কথা বলছিলেন যে ম্যাডাম, তিনি আর নেই বিশ্বাস করতে পারছি না। যা হলো, আমি আমৃত্যু ভুলতে পারব না। এমন মারাত্মক ভয় আমি জীবনে পাইনি। চোখের সামনে ভাসছে ম্যাডামের মুখটা।
কী হয়েছিল রাতের রাস্তায়?
ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে। বুদবুদের কাছে পেট্রোল পাম্প থেকে তেল ভরে বেরোনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটল ঘটনাটা। ম্যাম ফোনে কথা বলছিলেন। আচমকা দেখলাম পিছন থেকে একটা সাদা গাড়ি এসে আমাদের ওভারটেক করে আবার স্লো হয়ে গেল। ডানদিকের ইন্ডিকেটর জ্বেলে কাচ নামিয়ে আমাকে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল। কিন্তু যেই সাইড দিয়ে বেরোতে গেলাম আবার চেপে দিল। গাড়িটা সামলাতে গিয়ে ডানদিকটা ডিভাইডারে ঘষে গেল। তখনই আমার মন বলছিল কিছু ঝামেলা হতে চলেছে। নইলে ফাঁকা রাস্তায় শুধু শুধু কেন ডানদিকে চাপছে। আমি তো ঠিক লাইনেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। তখনই আমার প্রথম ভয় লাগে।
বিপদ বুঝে আমি গাড়ির গতি কমিয়ে পিছিয়ে যাই। ওদের এগিয়ে যেতে দিই। সামনেই ছিল হাই রোড। পানাগড়ের পুরোনো রাস্তা থেকে যেই হাইরোডে উঠব আবার ওদের গাড়িটা এসে সামনেটা আটকে দিল। সামলাতে আমাকে গাড়ি ঘুরিয়ে ডানদিকের রাস্তায় ঢুকিয়ে দিতে হয়। আমি তখন বুঝে যাই এদের মতলব ভালো নয়। তাকিয়ে দেখি চলন্ত গাড়িতে সবাই মিলে মদ খাচ্ছে। মদের গ্লাস এখনও ওই গাড়িতেই পড়ে আছে। মদ খেতে খেতে সমানে আমাদের গাড়ির দিকে খারাপ ইশারা করছিল। আমি বুঝে যাই, আমাকে ওখান থেকে বেরোতেই হবে, কারণ গাড়িতে ম্যাডাম আছেন।
তখন আমরা প্রত্যেকেই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম ওরা যে ভাবে আমাদের গাড়িটাকে চেজ় করছে, তাতে ওদের বদ মতলব রয়েছে তা স্পষ্ট। এরা কিডন্যাপার হতে পারে, ছিনতাইবাজ হতে পারে.... অনেক চিন্তা মাথায় আসছিল। আমি তো বটেই, গাড়ির বাকিরাও ম্যাডামের জন্য বেশি চিন্তা করছিলেন। ওঁকে বিপদে পড়তে দেওয়া যাবে না।
আমি তখনই ভেবে নিই গতি বাড়িয়ে এদের ছাড়িয়ে দার্জিলিং মোড় দিয়ে বেরিয়ে যাব। আমি গাড়ি ঘোরালেও ওরা ব্যাক করে আসে। পিছনদিক থেকে ওভারটেক করে এসে ডানদিকে সপাটে একটা ধাক্কা মারে। তখনই আমাদের গাড়িটা একেবারে উল্টে যায়। গাড়ির চারটে চাকা উপরে, আমরা সবাই তলায়। ম্যাডামের তখন থেকেই আর কোনও সাড়া শব্দ পাচ্ছিলাম না। গাড়ি থেকে বার করে হাসপাতালেও নিয়ে যাই। রাস্তায় একটা অ্যাম্বুলেন্সও পাই। ওই চালকও খুব সাহায্য করেন। কিন্তু ম্যাডামকে বাঁচাতে পারিনি। স্পটেই মনে হয় তিনি মারা গিয়েছিলেন। ভুলতে পারছি না সুতন্দ্রা ম্যাডামের মুখটা। টানা ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার মতো রাস্তা চলেছে এই চেজ়িং। ওই শয়তানগুলোর ধাক্কাতেই উল্টোয় গাড়ি।
(বক্তা সুতন্দ্রা চট্টোপাধ্যায়ের গাড়ির চালক। মৃতা ও তাঁর ডান্স ট্রুপ গয়ায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপরই)