সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
স্কুল থেকে ফিরে সে খেলতে যায় না। তবে পড়তেও বসে না। এমনকী, স্কুল থেকে ফিরেই সে মোবাইল ফোন নিয়েও বসে পড়ে না। বাড়ি ফিরে একটু কিছু খেয়ে সে সোজা চলে যায় স্থানীয় কালীচণ্ডী বাজারে। তার পর সে তার পসরা নিয়ে সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতাদের সামলায়। একাই।
দাঁতনের ওই বাজারে প্রতিদিন ফুচকা বিক্রি করে স্থানীয় ভাগবতচরণ হাইস্কুলের একাদশের বিজ্ঞানের ছাত্র সন্দীপ দাস। সন্দীপের বাড়ি দাঁতন থানার কারকপুর গ্রামে। স্কুল থেকে ফিরে তার পর রিকশা ভ্যানে ফুচকা বিক্রির সরঞ্জাম নিয়ে সে রওনা হয় দু’আড়াই কিলোমিটার দূরে কালীচণ্ডী বাজারে। মা যমুনা দাস বাড়িতে বানিয়ে দেন ফুচকা। বিক্রি বক্রিবাটা শেষ হতে হতে সন্ধে গড়িয়ে রাত নামে। তার পরে বাড়ি ফেরে সন্দীপ। দারিদ্রের সংসারে পড়াশোনার পাশাপাশি সারা বছর এই কাজই করতে হয় সন্দীপকে।
সন্দীপের বক্তব্য, ফুচকা বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ তোলার পাশাপাশি সংসার চালানোতেও বাবা-মাকে সাহায্য করে সে। অষ্টম শ্রেণি থেকে এ ভাবেই নিজের পড়ার খরচ তুলে এসেছে সে। সন্দীপরা দুই ভাই। বাবা পঞ্চানন দাস এক সময় রিকশা চালিয়ে সংসারের হাল টেনেছেন। এখন রিকশার কদর কমায় কমেছে আয়ও। কিছুদিন আইসক্রিম বিক্রি শুরু করেন সন্দীপের বাবা। তার পর বাজারে স্থায়ীভাবে ফুচকা বিক্রি শুরু করেন।
কিন্তু একার উপার্জনে কি চারটি পেট চালানো যায়? ফলে ছোট্ট থেকেই স্কুল শেষে বাবাকে সাহায্য করতে শুরু করে দুই ছেলে সন্দীপ ও শুভদীপ। শুভদীপ পরে ফিজ়িওথেরাপি নিয়ে পড়তে চলে যায় বাঁকুড়া। ফলে খরচ আরও বাড়ে। তখন বাবা পঞ্চানন দাস গুজরাটে চলে যান কারখানার কাজ নিয়ে। সেই থেকেই সন্দীপ একা হাতে ফুচকার দোকান চালায়। মা যমুনাদেবী বলেন, ‘চাষের জমি নেই বললেই চলে। আবাস যোজনাতে বাড়িও মেলেনি। সরকারি সাহায্য বলতে শুধু লক্ষ্মীর ভাণ্ডারটি পাই। কিন্তু তা দিয়ে কি সংসার চলে? ছেলের ফুচকা বিক্রি ও স্বামীর উপার্জনেই বহুকষ্টে সংসার চলে। ধারদেনা করে একটি ছোট্ট ঘর করেছি। সেটিও সম্পূর্ণ ঠিক করতে পারিনি।’
কেমন লাভ হয় ফুচকা বিক্রি করে?
সন্দীপ বলেন, ‘বাজারে অনেক দোকান। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমি ভালো ফুচকা দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে সবদিন সমান আয় হয় না। কোনও দিন ৫০০ টাকা, তো কোনও দিন ৭০০ টাকাও রোজগার হয়।’
সন্দীপের স্কুলের প্রধান শিক্ষক অরবিন্দ দাস বলেন, ‘ওরা দুই ভাই ভীষণই ভালো। দারিদ্র্যের কারণে কয়েক বছর ফুচকা বেচছে। আবার পড়াশোনাও করছে। ওরা এতটাই অন্য ধরনের যে, গরিব বলে মানুষের কাছে সাহায্যের জন্যও হাত পাতে না। নিজেদের চেষ্টায় সব করে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের কাছে কিন্তু এটা শিক্ষণীয়।’