সঞ্জয় দে, প্রয়াগরাজ
দুর্ঘটনা, মৃত্যু, জখম আর দুমড়ে যাওয়া বাসের ছবি। মহাকুম্ভের সূচনাপর্ব থেকে এমন দৃশ্যই দেখে চলেছে দেশ, এই রাজ্যও। প্রয়াগরাজের পথে পুণ্যার্থীদের প্রাণহানি প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। দুর্ঘটনা এড়িয়ে কুম্ভে পৌঁছে স্নান সেরে সুষ্ঠু ভাবে বাড়ি ফিরেছেন যাঁরা, তাঁদের প্রায় প্রত্যেককে রাস্তায় তীব্র যানজটে ভুগতে হয়েছে।
দেখতে হয়েছে কয়েক কিমি এলাকা জুড়ে অচল ট্র্যাফিকের ছবি। যেখানে হুটার বাজিয়েও এগোতে পারেনি অ্যাম্বুল্যান্স। রোগীকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় থাকতে দেখা গিয়েছে পরিবারের লোকেদের। এখানেই উঠে এসেছে বেঙ্গল মডেলের প্রসঙ্গ।
কেন এই অব্যবস্থা?
মহাকুম্ভের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য অমিত দে বলেন, ‘ভিড় সামলাতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ–প্রশাসনের যে তৎপরতা দেখা গিয়েছে, তার সিকি ভাগ চোখে পড়েনি ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে। শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, ঠিকমতো ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি ঝাড়খণ্ড, বিহারেও। ফলে কখনও দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে পুণ্যার্থীদের গাড়ি, কখনও জ্যামে ফেঁসে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে কয়েক ঘণ্টা।’
কলকাতা থেকে মহাকুম্ভে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র মিশ্র। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মহাকুম্ভে যাওয়ার আগে আমি গঙ্গাসাগরে গিয়েছিলাম। কুম্ভের থেকে অনেক ভালো ব্যবস্থা ছিল সেখানে। যান চলাচল, মেলা প্রাঙ্গণে ভিড় নিয়ন্ত্রণ, সবই দক্ষতার সঙ্গে করা হয়েছে। কিন্তু কুম্ভের রাস্তায় শুধুই জ্যাম।’
আসানসোল–দুর্গাপুর থেকে মহাকুম্ভে গিয়েছেন বহু পুণ্যার্থী। তাঁদের কথায়, ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনের উচিত ছিল বেঙ্গল মডেল ফলো করা। কী সেই মডেল? ওই পুণ্যার্থীরা বলছেন, মাস দেড়েকও হয়নি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা ভিড় করেছিলেন গঙ্গাসাগরে। সেই সময়ে রাজ্যের একেবারে সীমানা এলাকা বরাকর থেকে যান নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। বরাকর, দুর্গাপুর, বর্ধমান সমেত ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কের একাধিক জায়গায় পণ্যবাহী ট্রাক দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় সার্ভিস রোডে।
একমাত্র জরুরি পরিষেবার গাড়ি যেমন দুধ, ওষুধ, খাদ্যসামগ্রীর গাড়ি জাতীয় সড়ক দিয়ে যাতায়াতের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তাতে পুণ্যার্থীদের গাড়ি নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতা হয়ে গঙ্গাসাগরে পৌঁছতে অসুবিধা হয়নি কারও। একই ভাবে দুর্গাপুজোর সময়েও জাতীয় সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রাতে প্রতিমা দেখার ভিড় কমলে তবেই জাতীয় সড়কে ট্রাক–লরি যাতায়াতে অনুমতি দেওয়া হয়।
এ ছাড়া জাতীয় সড়কের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় মোতায়েন করা হয় ট্র্যাফিক কর্মী ও আধিকারিকদের। আসানসোল–দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের ট্র্যাফিক বিভাগের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, এই পদ্ধতিতেই যান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দুর্ঘটনা রোখা গিয়েছে এখানে।
তবে উত্তরপ্রদেশে যাও বা গাড়ি কিছুটা গড়িয়েছে, বিহারে একেবারে নড়েনি। সেখানে নিয়মের তোয়াক্কা না করে জাতীয় সড়কে চালকদের ওভারটেক করার ঘটনা সামনে এসেছে। অনেকে উল্টো লেনে গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ফলে জাতীয় সড়কের দু’দিকই যানজটে পড়েছে। এমনকী বাদ যায়নি সার্ভিস রোডও।
জাতীয় সড়ক ছেড়ে অনেকে সার্ভিস রোড ধরে গাড়ি নিয়ে যাওয়ায় সেখানেও গাড়ি এগোয়নি। জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুল্যান্স চালক অশোক শর্মার অসহায় উক্তি, ‘গাড়িতে রোগী, হুটার বাজাচ্ছি কিন্তু, আগে যাওয়ার জায়গাই পাচ্ছি না। ১০ কিমি রাস্তা যেতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগছে। সাহায্যের জন্য যে ট্র্যাফিক পুলিশকে বলব, তাঁদেরও দেখা পাচ্ছি না।’
মহাকুম্ভ থেকে স্নান করে এসেছেন দুর্গাপুর পুরসভার এগজ়িকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার দেবব্রত বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘রাস্তা ফাঁকা থাকলে প্রয়াগরাজ থেকে দুর্গাপুরে আসতে কম বেশি ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে আমাদের সময় লেগেছে ২৪ ঘণ্টা। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। কোনও ট্র্যাফিক পুলিশের দেখা মেলেনি। কী জন্য জ্যাম তাও বোঝা যায়নি। ম্যানমেড জ্যাম বলে মনে হলো।’
ওই ইঞ্জিনিয়ারদের গাড়িও দুর্ঘটনায় পড়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে একটি ট্রাক পিছন থেকে এসে আমাদের গাড়ির লুকিং গ্লাস ভেঙে দিল। কোনও কারণ ছিল না। সামান্য যান নিয়ন্ত্রণ করলেই এগুলো এড়ানো যেত।’