• ১৮ কিমি ধাওয়া, গাড়ি উল্টে মৃত্যু নৃত্যশিল্পীর
    এই সময় | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • সঞ্জয় দে, দুর্গাপুর

    রবিবার প্রায় মাঝরাত। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটছিল দু’টি গাড়ি। একটি সাদা রঙের ক্রেটা এসইউভি। অন্যটি ছোট তিয়াগো। কখনও একটি গাড়ি অন্যটিকে টপকে এগিয়ে যাচ্ছে, কখনও পিছিয়ে পড়ছে। আচমকা মনে হতে পারে, সিনেমার শুটিং-য়ে কার–চেজ়ের দৃশ্য। বাস্তবে, ১৮ কিলোমিটার ধরে এই রেষারেষিতে তিয়াগো উল্টে মৃত্যু হলো গাড়ির মালিক সুতন্দ্রা চট্টোপাধ্যায়ের (২৭)। চাকা ফাটলো ক্রেটারও। অভিযোগ, ক্রেটা থেকে নেমে ছুটে পালান পাঁচ যুবক। সুতন্দ্রা ও গাড়িচালক-সহ তিয়াগোয় ছিলেন পাঁচ জন। সামান্য জখম হন বাকিরা। হুগলির চন্দননগরের বাসিন্দা সুতন্দ্রা একটি নাচের দল চালান। রবিবার রাতে দলের তিন সদস্যকে নিয়ে বিহারের গয়ায় যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পরে পুলিশ জখমদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। রাজবাঁধের একটি বেসরকারি হাসপাতালে সুতন্দ্রাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।

    মর্মান্তিক এই ঘটনার পরে দু’টি পরস্পরবিরোধী বয়ান পাওয়া গিয়েছে। একটি বয়ান সুতন্দ্রার গাড়িচালক রাজদেও শর্মা–র। অন্যটি আসানসোল–দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার সুনীলকুমার চৌধুরির। রাজদেওয়ের বয়ান — বর্ধমানের বুদবুদ থেকে ক্রেটা তাঁদের পিছু নিয়েছিল। ওই চলন্ত গাড়ি থেকেই সমানে সুতন্দ্রার দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করছিলেন আরোহীরা। রাজদেওয়ের দাবি, তাঁরা গাড়িতে বসে মদ্যপানও করছিলেন (পুলিশ জানিয়েছে, ক্রেটার ভিতরে মদের বোতল, গ্লাস, বাদামের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছে)। আধ ঘণ্টার মধ্যে সুতন্দ্রাদের গাড়িটির বাঁ দিকে তিন বার ধাক্কা মারে ক্রেটা। রাজদেওয়ের অভিযোগ, সম্ভবত কিডন্যাপিংয়ের উদ্দেশ্যে এক্সপ্রেসওয়ের উপরেই তাঁদের গাড়িকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে ক্রেটা। এমনকী, ক্রেটা ডান দিক থেকে এমন ভাবে তাঁদের তিয়াগোর ঘাড়ের উপরে উঠে আসে যে, এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে তাঁরা পানাগড়ের রাস্তা নিতে বাধ্য হন। সেখানেও পিছু নেয় ক্রেটা। অন্ধকার গলিতে সুতন্দ্রাদের গাড়িটি উল্টে যায়। চালকের বয়ান থেকে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, গাড়িটি উল্টে যাওয়ার সময়ে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশের স্তূপে কোনও ভাবে সুতন্দ্রার মাথায় আঘাত লাগে। তার জেরেই মৃত্যু হয় সুতন্দ্রার।

    সোমবার সন্ধ্যায় আসানসোল–দুর্গাপুর কমিশনারেটের সিপি সুনীল চৌধরি ফোনে ‘এই সময়’–কে যা বলেন, তা একেবারে উল্টো। তাঁর বক্তব্য, ‘ক্রেটাকে প্রথমে ওভারটেক করতে যায় তিয়াগো। গতিতে ক্রেটার ডান দিক দিয়ে ওভারটেক করার সময়ে তিয়াগোর ডানদিকটা ঘষে যায় রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারে। ক্রেটা এগিয়ে যায়। এরপরেই ক্রেটাকে চেজ় করতে শুরু করে তিয়াগো।’ সিপি–র যুক্তি, তিয়াগোর যাওয়ার কথা ছিল গয়ায়। তার তো থাকার কথা ছিল এক্সপ্রেসওয়ের উপরেই। ক্রেটা পানাগড়ের লোকাল গাড়ি। সে এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে পানাগড়ের দিকে বেঁকে যায়। কিন্তু, চেজ় করতে করতে তিয়াগো–ও পানাগড়ে ঢুকে পড়ে। স্থানীয় সরু গলি ক্রেটাচালকের চেনা থাকলেও তিয়াগো ড্রাইভারের অচেনা। তাই, সরু গলির ভিতরে বাঁক নিতে গিয়ে উল্টে যায় সে। তাতেই মারা যান সুতন্দ্রা।

    পুলিশ সূত্রের খবর, রাজদেও এবং গাড়ির অন্য তিন আরোহীর সঙ্গে সোমবার সন্ধে থেকে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন কমিশনারেটের তদন্তকারীরা। গাড়ির আরোহীদের বয়ান অনুযায়ী, একটি অভিযোগও জমা পড়েছে পুলিশের কাছে। তবে পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ক্রেটা তাঁদের গাড়িটিকে ধাওয়া করছিল বলে আরোহীরা দাবি করলেও ইভটিজ়িংয়ের বিষয়টি নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। সেই জট কাটাতে সোমবার রাত পর্যন্ত রাজদেও এবং অন্য এক আরোহীর সঙ্গে কথা বলেন তদন্তকারীরা। বাকি দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

    সিপি–র কথায়, ‘স্থানীয় সিসিটিভি ক্যামেরার ছবি এবং তিয়াগোয় থাকা যাত্রীদের বয়ান খতিয়ে দেখে তদন্ত চলছে। দেখা যাক কী বেরোয়।’ এ দিন দুপুরে সংবাদমাধ্যমের সামনে কার্যত কিডন্যাপিংয়ের চেষ্টার অভিযোগ তোলেন রাজদেও। যদিও কমিশনারের দাবি, ‘সে রকম কিছু পুলিশকে তিনি জানাননি। আপনাদের জানিয়ে থাকতে পারেন।’ উল্লেখ্য, ঘটনার পর থেকে স্থানীয় কাঁকসা থানায় বসেছিলেন রাজদেও–সহ তিয়াগোয় থাকা চারজন। দুপুরে চা খেতে রাজদেও থানা থেকে বেরোতেই তাঁকে সাংবাদিকেরা ঘিরে ধরেন। তিনি তখন সাজানো ছবির মতো ঘটনার বিবরণ দেন। একাধিক টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাতেও সেই বয়ান রেকর্ড হয়েছে।

    পুলিশ ও রাজদেওয়ের দু’টি পরস্পরবিরোধী বয়ান থেকে উঠে এসেছে একাধিক প্রশ্ন। এক, রাজদেও সাংবাদিকদের যে বয়ান দিলেন, তা কি পুলিশকে জানিয়েছিলেন, নাকি তা গ্রাহ্য করা হয়নি? দুই, যাঁরা অনুষ্ঠান করতে এতদূরে গয়া যাচ্ছিলেন, তাঁরা একটি গাড়িকে চেজ় করতে এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে রাতের অন্ধকারে অচেনা জায়গায় কেন ঢুকতে গেলেন? তিন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ির চালক, যাঁর চোখের সামনে পাশে বসা মালকিন মারা গেলেন, তাঁর পক্ষে এত গুছিয়ে ‘মিথ্যা’ বয়ান দেওয়া কতটা সম্ভব? চার, ক্রেটার চালক ও যাত্রীরা যদি কোনও দোষই না করেন, তা হলে তিয়াগো দুর্ঘটনায় পড়ার পরে, আহত মহিলা ও অন্য যাত্রীদের ফেলে তাঁরা কেন পালিয়ে গেলেন?

    কারা এই যুবকের দল?

    জানা গিয়েছে, এঁরা সকলেই স্থানীয় বাসিন্দা। মূলত কাবাড়িওয়ালা বলে পরিচিত, যাঁরা ছাঁট লোহার কারবার করেন। পুলিশ জানিয়েছে, ক্রেটার মালিক পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসায়ী বাবলু যাদব। তিনি গাড়িতে ছিলেন না। স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশের একাংশের ‘সুসম্পর্ক’ সর্বজনবিদিত। ফলে, প্রশ্ন উঠেছে, কাউকে কি বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে? সিপি সুনীল চৌধরির সাফ জবাব, ‘আপনার কি মনে হয়, কাবাড়িওয়ালাদের স্বার্থে একজন কমিশনার মিথ্যা কথা বলবেন?’

    শুধু রাজদেও নন, সুতন্দ্রার গাড়িতে থাকা মিন্টু মণ্ডলেরও দাবি, রাতে বুদবুদে একটি পাম্পে পেট্রল ভরে বেরোনোর পরেই তাঁদের ধাওয়া করতে থাকে ক্রেটা। তিনি বলেন, ‘ওরা সকলেই মত্ত অবস্থায় ছিল। আমাদের গাড়িতে এসে ধাক্কা দেয়। আমরা রাস্তা ছেড়ে দিয়েছিলাম যাতে ওদের গাড়িটা বেরিয়ে যায়। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ম্যাডামের (সুতন্দ্রা) দিকে হাত নেড়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করছিলেন ওঁরা। গাড়িতে ম্যাডাম রয়েছেন। আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। গাড়ি থামালে ওরা ম্যাডামকে কিডন্যাপ করতে পারত।’ যুবকদের হাত থেকে বাঁচতেই তাঁরা অন্য একটি রাস্তা ধরেন, দাবি মিন্টুর। রাজদেও বলেন, ‘সেই রাস্তাতেও পিছু ধাওয়া করে আরও দু’বার ধাক্কা দেয় আমাদের গাড়িকে। তৃতীয় ধাক্কায় আমাদের গাড়িটা একটি বাড়িতে ধাক্কা মেরে উল্টে যায়। পিছনের চাকা ফেটে যায়। ম্যাডাম ওখানেই মারা যান।’ তিয়াগোর অন্য যাত্রীদের আঘাত গুরুতর না–হলেও গাড়ি উল্টে যাওয়ার অভিঘাতে অথবা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা যন্ত্রাংশের স্তূপ বা ভারী কিছুতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান সুতন্দ্রা। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্ঘটনাটি ঘটে রাত ১২.২০ নাগাদ। ক্রেটার সামনের ডান দিকের চাকা ফেটে যায়। চিৎকার চেঁচামেচিতে স্থানীয়েরা চলে আসেন ঘটনাস্থলে। রাত ১টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ।

    সুতন্দ্রার মা তনুশ্রী জানিয়েছেন, রবিবার মেয়ের এক বন্ধুর বিয়ে ছিল। সেখান থেকে রাতে তাঁরা গয়ার উদ্দেশে রওনা হন। রাত ১২টার কিছু আগে তনুশ্রীর সঙ্গে ফোনে শেষ কথা হয় মেয়ের। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সোমবার সকালেই তিনি পৌঁছে যান পানাগড়ে। ময়নাতদন্তের পর মহকুমা হাসপাতাল থেকে সুতন্দ্রার দেহ নিয়ে চন্দননগরে রওনা দেন তিনি। পানাগড় ছাড়ানোর পরে খবর আসে সুতন্দ্রার সহকর্মীদের আটকে রেখেছে পুলিশ। সুতন্দ্রার দেহ নিয়ে ফের কাঁকসা থানায় চলে আসেন পরিবারের লোকজন। পরে তাঁরা দেহ নিয়ে রওনা দেন চন্দননগরের উদ্দেশে।

  • Link to this news (এই সময়)